পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 মানিকবাবু সহরতলীতে শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের নানা মানুষের কাহিনী বলেছেন। তাদের শ্রেণী হিসেবে চিনতে চেয়েছেন, কিন্তু একমেটে পরিচয়ে, কোনো রাজনৈতিক ভাবাদর্শের চিহ্নে নিঃশেষে বুঝে উঠতে চান নি। তাদের স্বতন্ত্র করে এঁকেছেন।

 যশোদার রাজনৈতিক বুদ্ধি নেই। কিন্তু সহজ প্রেমে সে বহুশক্তি মালিকের সঙ্গে লড়েছে। কৌশলের কাছে হেরেছে, কিন্তু শ্রমিকদের প্রতি ভালোবাসা হারায় নি। উত্তর পর্বে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাস একটা আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। যশোদার বিরক্তিমিশ্র প্রীতিতে, ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতায়, শ্রেণীগত ভালোবাসায় মানিকবাবুর রাজনৈতিক ভবিতব্যের ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়।

 সহরতলী৩ে সুঅঙ্কিত মানুষ অনেক। সরল জটিল ভাঙাচোরা গভীর নানা মানুষ। প্রায়ই তারা অসমাপ্ত রেখায়, অল্প অবকাশে মনের আরণ্য গহনতার ইঙ্গিতবাহী। কীর্তনের আবেগ উদ্বেল নন্দর স্বায়ুবিকলতা, কুমুদিনীর বিরূপ সখীত্ব, ভগ্ন-মেরুদণ্ড জ্যোতির্ময়ের পদলেহন, অজিত-সুব্রতার হিসেবী তারুণ্য, বিদ্রোহী জামাতা যামিনীর আত্মসমর্পণের আগ্রহে ধনাঢ্য শ্বশুরের অঙ্গুলিহেলনের ব্যাকুল প্রতীক্ষা, বনলতার ঈর্ষাকুটিল স্বায়ুবিকার, সুবর্ণর প্রণয়-হিষ্টিরিয়া। দ্বিতীয় পর্বের ভদ্রলোকেদের প্রসঙ্গে বর্ণ বিরলতা প্রকট। এই অংশের পরিকল্পনায় - শুরু এবং সমাপ্তির আকস্মিকতায় ঔপন্যাসিকের কোনো সরল বা জটিল অভিপ্রায়ই অনুভূত নয়।

 যশোদার চরিত্রের মূল বদলায় নি। অনেক মানুষের অবিরাম আসা যাওয়া তার বাড়ির এবং মনেরও পান্থশালায়। সেই ভাসমান নর-নারী চলমান ছবির মত মনের পর্দায় বয়ে রেখাপাত করে গেছে, তার অস্তিত্বে গভীর কর্ষণের দাগ রাখে নি।


 মিল মালিক সত্যপ্রিয়ের কুশল মুখোসবৃত্তি, চতুর দেশদ্রোহ, বিগতচিত্ত নিম্পৃহা, সূক্ষ্ম মুনাফাবুদ্ধি, ঝুটা মূল্যবোধের চাকচিক্য, মানবদুর্বলতা বিষয়ে প্রজ্ঞা এবং তার পূর্ণ ব্যবহার একটা চমৎকার ভর্ৎসনাতিক্ত ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেছে। তবুও বলা যায় এই সব উপাদানের মধ্যে মুখ্য চরিত্র অভিপ্রায়ের বিরোধিতা কোথাও নেই; - সূত্রগুলি তার শ্রেণীস্বার্থানুগ; নীরাক্ত হননে নিরীহ।

 তবুও সত্যপ্রিয়ের এ জটিলতা আপাত, প্রকৃত নয়। মানিকবাবু এতে