পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Σ δΝ মানিক রচনাসমগ্ৰ অনন্ত বিস্মিত হইয়া বলিল, কেন? এখানে শোবার ঘর নেই ? আছে। কিন্তু তুমি যাও। এই ভাঙা বাড়িতে রাত কাটাবে কোন দুঃখে ? কেতকীর পাংশু-মুখের দিকে চাহিয়া অনন্ত হাসিয়া বলিল, বেচারিরা ভয়ে ভয়ে চারিদিকে চাইছে, দরকার না থাকলে ওদের ছুটি দাও কেতকী। তুমি যাবে না? তুমি যদি যাও, যেতে পারি। যাবে? কেতকী নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আচ্ছা তোমরা যাও ঠাকুর। অনুমতি পাওয়ামাত্র তারা এমনভাবে প্রস্থান করিল যে অনন্ত হাসি চাপিতে পারিল না। কেতকী মানমুখে বলিল, তুমি হাসছ, আমার যা হচ্ছে ভগবান জানেন। কী থমথম করছে চারিদিক । অনন্ত হাসি বন্ধ করিল। হাসা তাহার উচিত হয় নাই। বাজনা নাই, ভক্তের কোলাহল নাই, একক পুরোহিতের নীরব পূজা। রাত্রির সঙ্গে গুমোট বাড়িয়াছে। তারার জগতে এখন মেঘের পরিপূর্ণ অমাবস্যা। কোথাও যেন শব্দ নাই, জীবনের স্পন্দন নাই, নিশ্চল পাষাণ মুর্তির সামনে ধ্যানস্থ ভক্তের মতো সমস্ত জগৎ যেন একটা ভয়ংকর অবরুদ্ধ শক্তির মুক্তি পাইবার প্রতীক্ষায় সমাধি পাইয়াছে। মাঝে মাঝে এক একটা রাত্রিচর পাখি ডাকিয় ওঠে, বটগাছে দুটি তক্ষক পালা করিয়া বীভৎস আর্তনাদ করে, মন্দিরের গায়ে ছোটাে ছোটাে চতুষ্কোণ ফাকগুলিতে যে বন্য-কপোতেরা আশ্রয় লইয়াছে তারা পাখা ঝাপটায়, মন্দিরের পিছনে জঙ্গলাকীর্ণ শুষ্কপ্রায় দীঘিতে ছপছপা করিয়া কী মেন হাঁটে। একটা বড়ো গুবরে পোকা দেবীকে ঘিরিয়া বেঁবো করিয়া পাক খাইতে খাইতে বারিকয়েক একদিকের দেওয়ালে মাথা ঠুকিয়া মেঝেতে পড়িয়া যায়। কিন্তু এই সব বিচিত্র শব্দে ও অবিশ্রান্ত বিঝির ডাকে স্তব্ধতা বাড়ে বই কমে না। শঙ্করের মুখের দিকে চাহিয়া অনন্ত অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। দেবীকে দক্ষিণে রাখিয়া সে পাশাপাশি হইয়া বসিয়াছে, ঠোঁটে মৃদু-মৃদু হাসির আভাস, অর্ধনিমীলিত চোখে স্তিমিত চাহনি। প্রশস্ত কপালে যেন অনুর্বর প্রান্তরের কঠোরতা। বলি হইয়া গিয়াছিল, প্রতিমার সামনে ছিন্ন ছগমুণ্ডের নৈবেদ্য ও একপােত্র শোণিতের পানীয়। প্রতিমার চোখ-দুটি আগুনের মতো জ্বলিতেছে, কিন্তু রক্ত তিমি একবিন্দুও পান করেন নাই। শঙ্করের কপালেই একটি রক্তের ফোটা জমাট বঁধিয়া আছে। জামার হাতায় টান পড়িতে অনন্ত সচেতন হইয়া উঠিল। চাহিয়া দেখে, কেতকী কঁাপিতেছে। চলে এসো। আমার ভয় করছে। কথাটা শঙ্করের কানো গেল । ভয় করছে। কেতকী? মার কাছে অভয় প্রার্থনা করো। পুনরায় অনন্তকে টানিয়া কেতকী বলিল, এসো। শঙ্কর বলিল, মাকে প্ৰণাম করে যাও কেতকী। এসো মার মাথার সিঁদুর তোমায় পরিয়ে দিই। মার, দয়ায় সব ভয় ভুলে যাবে। মা আমার সকলকে ক্ষমা করেন—সকলকে। এ যেন ছাগশিশুর চেয়ে অসহায়ের উপর হত্যার চেয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচার। কেতকী গলায় আচল জড়াইয়া প্ৰণাম করিতে যাইতেছিল, অনন্ত তাহার হাত চাপিয়া ধরিল। বলিল, মনে মনে প্ৰণাম করো কেতকী। মা মনের প্রণামেই খুশি হন। চলো।