পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in Str মানিক রচনাসমগ্র বাড়িঘরে সপরিবারে বাস করিবার সৌভাগ্য তার বেশিদিন স্থায়ী হইতে পারিত না, গোপাল সেনদিদিকে বলিত, এবার তাড়াও ওদের ; সেনদিদি ওদের বলিত, এবার তোমরা এসো। একটা গুরুতর মামলার শুনানি উপলক্ষে গোপাল আজ বাজিতপুরে গিয়াছিল। কোর্টে কাজ থাকিলে সেদিন গোপাল গ্রামে ফেরে না, আজ ফিরিল। রাত্রি প্রায় দশটার সময়। সেনদিদির খবরটা আসিল গোপাল যখন খাইতে বসিয়াছে—শশীর সঙ্গে। খবরটা দিল কৃপানাথ স্বয়ং। এই তো বিপদ দাদা। আপনাকে একবার যেতে হচ্ছে। গোপাল শুল্কমুখে কাতরভাবে বলিল, আমি গিয়ে কী করব হে? কৃপানাথ বলিল, একবার যেতে হচ্ছে। একটা বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে— বুদ্ধি পরামর্শ? বিপদে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে যাওয়াটা দোষের নয়, গোপাল তাড়াতাড়ি খাওয়া শেয করিয়া উঠিয়া গেল। ধীর স্থির থাকবার চেষ্টা করে গোপাল কিন্তু চাঞ্চল্য চাপিতে পারে না। বাড়ির মেয়েরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মাথা হেঁট করিয়া শশী নীরবে খাইয়া যায়। ও বাড়িতে গিয়ে কৃপানাথকে গোপাল কী পরামর্শ দেয় সেই জানে, খাইয়া উঠিযা শশী ঘরে গিয়া বসিতে না বসিতে সে আবার আসিয়া হাজির হয়। বলে, তোমাকে একবার যেতে হবে শশীী। শশী বলে, আমাকে অনুগ্রহ করে তুমি বলবেন না। আঁ্যা ? বলিয়া কৃপানাথ একটু থামে। শীর্ণ মুখখানা তাহার একটু লম্বাটে হইয়া যায। ভাবিদ্যা বলে, আমি আপনার পিতৃবন্ধু শশী বলে, আপনি যান মশায, আমার ঘুম পেয়েছে। কৃপানাথ আবার একটু থামে। থতোমতো ভাবটা কাটিতে একটু সময় লাগে তার। তারপর সংস্কৃত শ্লোক বলার মতো গড়গড় করিয়া বিপদের কথা বলিয়া যায়, চোখ দুটাে তাব ছলছল কবে। শশী না গেলে সেনদিদি বাঁচিবে না, গেলেও বঁচিবে কিনা ভগবান জানেন, তবু যতক্ষণ আশা কিনা তাই দয়া করে আপনি একবার চলুনু শশীবাবু। গাঁয়ে আর ডাক্তার নাই, কৃপানাথ নিজে যদিও চিকিৎসক, এ সব হাওগামার ব্যাপার সে বোঝে না, জ্বর-জ্বালা হয়। পাচন-বড়ি দিয়া চোখের পলকে সারাইয়া দিবে, এ তো তা নয়। শশী ভিন্ন সেনদিদির এখন আর গতি নাই। শুনিতে শুনিতে শশীর মনে পড়ে সেনদিদির সেই বসন্ত হওয়ার ইতিহাস, অসময়ে সাতগার একটি বসন্তরোগীর দেহেব বীজাণু দু-মাইল মাঠঘাট বাড়িঘর ডিঙাইয়া সেনদিদির দেহে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, যামিনীর চেলী ছিল সাতগাঁর রোগীটার চিকিৎসক। সেদিন এ বাড়িতে গোপাল আর ও বাড়িতে যামিনী তাকে সেনদিদির চিকিৎসা করিতে দেয় নাই। কত যুক্তি তর্ক অপমান আস্ফালনের বাধা ঠেলিয়া সেনদিদিকে সে বঁাচাইয়াছিল,-এক রকম গায়ের জোরে। আজ আবার অন্য কারণে সেনদিদি মরিতে বসিয়াছে। আজ তার চিকিৎসা করিতে বাধা নাই, নিজে গোপাল ডাকিয়া পাঠাইয়াছে। কোন ডাকিয়াছে? পুত্ৰ বলিয়া এ ভাবে তাকে ডাকিবার অধিকার কে দিয়াছে গোপালকে ? সেনদিদি মরুক বঁচুক শশী কী গ্ৰাহ্য করে? আমন কত রোগী শশীর নিজের হাতে মরিয়াছৌ-সেনদিদি তো আজ শশীর রোগীও নয়। আর সমস্ত কথা সে যদি ভুলিয়াও যায়, যদি শুধু মনে রাখে যে সে ডাক্তার, মরণাপন্ন রোগীর আত্মীয় তাকে ডাকিতে আসিয়াছে, তবু না যাওয়ার অধিকার তার আছে। দেহ তার অসুস্থ দুর্বল, সমস্ত দিন খাটিয়া খাটিয়া সে শ্রান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, এখন ডাক আসিলে সে ফিরাইতে পারে বইকী! তার কি বিশ্রামের দরকার নাই ? কৃপানাথ ক্ষুন্নমনে চলিয়া গেলে আলোটা কমাইয়া শশী খাটে বসিয়া একটা মোটা চুরুট ধরাইল। আজকাল বিড়ির বদলে সে চুরুট খায়।