পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে ২৬৭ পাচিলের ষে-ধারটিতে গ্যালারির মতো করে থাকে-খাকে চন্দ্রমল্লিকার টব সাজানো রয়েছে সেইদিকে গিয়ে দেখি সেই পুষ্পিত সোপানশ্রেণীর তলায় ঘাসের উপরে কে চুপ করে শুয়ে আছে। আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। আমি কাছে যেতেই সেও চমকে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। তার পর কী করা যায় ? আমি ভাবছি আমি এইখান থেকে ফিরে যাব কিনা, বিমলাও নিশ্চয় ভাবছিল সে উঠে চলে যাবে কিনা। কিন্তু থাকাও যেমন শক্ত, চলে যাওয়াও তেমনি। আমি কিছু-একটা মন স্থির করার পূর্বেই বিমলা উঠে দাড়িয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বাড়ির দিকে চলল। সেই একটুখানি সময়ের মধ্যেই বিমলার দুর্বিষহ হুঃখ আমার কাছে যেন মূর্তিমান হয়ে দেখা দিল। সেই মূহুতে আমার নিজের জীবনের নালিশ কোথায় দূরে ভেসে গেল। আমি তাকে ডাকলুম, বিমল । 卓 সে চমকে দাড়াল । কিন্তু তখনো সে আমার দিকে ফিরল না । আমি তার সামনে এসে দাড়ালুম। তার দিকে ছায়া, আমার মুখের উপর চাদের আলো পড়ল। সে দুই হাত মুঠো করে চোখ বুজে দাড়িয়ে রইল। আমি বললুম, বিমলা, আমার এই পি জরের মধ্যে চারিদিক বন্ধ, তোমাকে কিসের জন্তে এখানে ধরে রাখব ? এমন করে তো তুমি বঁাচবে না। বিমলা চোখ বুজেই রইল, একটি কথাও বললে না। আমি বললুম, তোমাকে যদি এমন জোর করে বেঁধে রাখি তাহলে আমার সমস্ত জীবন যে একটা লোহার শিকল হয়ে উঠবে। তাতে কি আমার কোনো স্থখ আছে ? বিমলা চুপ করেই রইল। আমি বললুম, এই আমি তোমাকে সত্য বলছি—আমি তোমাকে ছুটি দিলুম। আমি যদি তোমার আর-কিছু না হতে পারি অন্তত আমি তোমার হাতের হাতকড়া ইব না । এই বলে আমি বাড়ির দিকে চলে গেলুম। না না, এ আমার ঔদার্য নয়, এ আমার ঔদাসীগু তো নয়ই। আমি যে ছাড়তে না পারলে কিছুতেই ছাড়া পাব না। যাকে আমার হৃদয়ের হার করব তাকে চিরদিন আমার হৃদয়ের বোঝা করে রেখে দিতে পারব না। অন্তর্ধামীর কাছে আমি জোড়হাতে কেবল এই প্রার্থনাই করছি আমি মুখ না পাই, নেই পেলুম ; দুঃখ পাই সেও স্বীকার কিন্তু আমাকে বেঁধে রেখে দিয়ে না । মিথ্যাকে সত্য বলে ধরে রাখার চেষ্টা ষে নিজেরই গলা চেপে ধরা। আমার সেই আত্মহত্য থেকে আমাকে বাচাও ।