পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

!" 8૨૭ রবীন্দ্র-রচনাবলী নীরদ মুখুজের এ বাড়িতে গতিবিধি ছিল। হেমন্ত ওর নাম দিয়েছিল জাউল, অর্থাৎ প্যাচা। অর্থ ব্যাখ্যা করতে বললে সে বলত, ও মানুষটা পৌরাণিক, মাইথ'লজিকাল, ওর বয়েস নেই, কেবল আছে বিদ্যে, তাই আমি ওকে বলি মিনার্ভার বাহন। নীরদ এদের বাড়িতে মাঝে মাঝে চ খেয়েছে, হেমন্তর সঙ্গে তুমুল তর্ক চালিয়েছে, মনে মনে উর্মিকে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছে, কিন্তু ব্যবহারে করে নি যে তার কারণ, এ ক্ষেত্রে যথোচিত ব্যবহারটাই ওর স্বভাবে নেই। ও আলোচনা করতে পারে, আলাপ করতে জানে না। যৌবনের উত্তাপ ওর মধ্যে যদি-বা থাকে, তার আলোটা নেই। এইজন্যেই, যে-সব যুবকের মধ্যে যৌবনটা যথেষ্ট প্রকাশমান তাদের অবজ্ঞা করেই ও আত্মপ্রসাদ লাভ করে । এই-সকল কারণে ওকে উমির উমেদার-শ্রেণীতে গণ্য করতে কেউ সাহস করে নি। অথচ সেই প্রতীয়মান নিরাসক্তিই বর্তমান কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওর পরে উর্মির শ্রদ্ধাকে সম্বমের সীমায় টেনে এনেছিল। . রাজারাম যখন স্পষ্ট করেই বললেন যে, যদি মেয়ের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে তবে নীরদের সঙ্গে তার বিবাহ হলে তিনি খুশি হবেন তখন মেয়ে অনুকূল ইঙ্গিতেই মাথাটা নাড়লে । কেবল সেইসঙ্গে জানালে, এ দেশের এবং বিলেতের শিক্ষার পালা সমাধা করে বিবাহ তার পরিণামে । বাবা বললেন, “সেই কথাই ভালো, কিন্তু পরস্পরের সম্মতিক্রমে সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেলে আর কোনো ভাবনা থাকে না।” নীরদের সম্মতি পেতে দেরি হয় নি, যদিও তার ভাবে প্রকাশ পেল, উদ্ববাহবন্ধন বৈজ্ঞানিকের পক্ষে ত্যাগ স্বীকার, প্রায় আত্মঘাতের কাছাকাছি। বোধ করি এই দুর্যোগ কথঞ্চিৎ-উপশমের উপায়-স্বরূপে শর্ত রইল যে, পড়াশুনো এবং সকল বিষয়েই নীরদ উৰ্মিকে পরিচালনা করবে, অর্থাৎ ভাবী পত্নী-রূপে ওকে ধীরে ধীরে নিজের হাতে গড়ে তুলবে। সেটাও হবে বৈজ্ঞানিকভাবে, দৃঢ়নিয়ন্ত্রিত নিয়মে, ল্যাবরেটরির অভ্রাস্ত প্রক্রিয়ার মতো । নীরদ উৰ্মিকে বললে, “পশুপক্ষীরা প্রকৃতির কারখানা থেকে বেরিয়েছে তৈরি জিনিস। কিন্তু মানুষ কাচা মালমসলা । স্বয়ং মানুষের উপর ভার তাকে গড়ে তোলা ৷” উমি নম্রভাবে বললে, "আচ্ছা, পরীক্ষা করুন। বাধা পাবেন না।” নীরদ বললে, “তোমার মধ্যে শক্তি নানাবিধ আছে। তাদের বেঁধে তুলতে হবে তোমার জীবনের একটিমাত্র লক্ষ্যের চারি দিকে । তা হলেই তোমার জীবন অর্থ পাবে। বিক্ষিপ্তকে সংক্ষিপ্ত করতে হবে একটা অভিপ্রায়ের টানে, অঁাট হয়ে উঠবে, ডাইনামিক হবে, তবেই সেই একত্বকে বলা যেতে পারবে মরাল অর্গানিজম, ।”