পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে বাইরে (ttre তার পরে মনে পড়ে, তখনকার দিনে জ্বর হলে কবিরাজের কঠোর শাসনে তিনদিন কেবল গরম জল আর এলাচদানা আমার পথ্য ছিল ; মেজোরানী আমার দুঃখ সইতে পারতেন না, কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে খাবার এনে দিয়েছেন, এক-একদিন ধরা পড়ে তীকে ভৎসনাও সইতে হয়েছে। তার পরে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখদুঃখের রঙ নিবিড় হয়ে উঠেছে ; কত ঝগড়াও হয়েছে ; ; বিষয়ব্যাপার নিয়ে মাঝে মাঝে অনেক ঈর্ষা সন্দেহ এবং বিরোধও এসে পড়েছে; আবার তার মাঝখানে বিমল এসে পড়ে কখনাে কখনো এমন হয়েছে যে, মনে হয়েছে বিচ্ছেদ বুঝি আর জুড়বে না। কিন্তু তার পরে প্রমাণ হয়েছে, অন্তরের মিল সেই বাইরের ক্ষতের চেয়ে অনেক প্রবল। এমনি করে শিশুকাল থেকে আজ পর্যন্ত একটি সত্য সম্বন্ধ দিনে দিনে অবিচ্ছিন্ন হয়ে জেগে উঠেছে; সেই সম্বন্ধের শাখাপ্রশাখা এই বৃহৎ বাড়ির সমস্ত ঘরে আঙিনায় বারান্দায় ছাদে বাগানে তার ছায়া ছড়িয়ে দিয়ে সমস্তকে অধিকার করে দাড়িয়েছে। যখন দেখলুম মেজোরানী তীর সমস্ত ছোটােখাটাে জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্স বোঝাই করে আমাদের বাড়ির থেকে যাবার মুখ করে দাড়িয়েছেন, তখন এই চিরসম্বন্ধটির সমস্ত শিকড়গুলি পর্যন্ত আমার হৃদয়ের মধ্যে যেন শিউরে উঠল। আমি বেশ বুঝতে পারলুম। কেন মেজোরানী, যিনি ন বছর বয়স থেকে আর এ পর্যন্ত কখনো একদিনের জন্যেও এ বাড়ি ছেড়ে বাইরে কাটান নি, তিনি তার সমস্ত অভ্যাসের বঁাধন কেটে ফেলে অপরিচিতের মধ্যে ভেসে চললেন । অথচ সেই আসল কারণটির কথা মুখ ফুটে বলতেই চান না, অন্য কত রকমের তুচ্ছ ছুতো তোলেন। এই ভাগ্যকর্তৃক বঞ্চিতা পতিপুত্রহীনা নারী সংসারের মধ্যে কেবল এই একটিমাত্র সম্বন্ধকে নিজের হৃদয়ের সমস্ত সঞ্চিত অমৃত দিয়ে পালন করেছেন, তার বেদনা যে কত গভীর সে আজ র্তার এই ঘরময় ছড়াছড়ি বাক্স-পুঁটুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে যত স্পষ্ট করে বুঝলুম এমন আর কোনোদিন বুঝি নি। আমি বুঝেছি টাকাকড়ি ঘরদুয়ারের ভাগ নিয়ে, ছোটােখাটাে সামান্য সাংসারিক খুঁটিনাটি নিয়ে, বিমলের সঙ্গে আমার সঙ্গে তঁর যে বার বার ঝগড়া হয়ে গেছে তার কারণ বৈষয়িকতা নয় ; তার কারণ র্তার জীবনের এই একটিমাত্র সম্বন্ধে তার দাবি তিনি প্রবল করতে পারেন নি, বিমল কোথা থেকে হঠাৎ মাঝখানে এসে একে স্নান করে দিয়েছে, এইখানে তিনি নড়তে-চড়তে ঘা পেয়েছেন, অথচ তীর নালিশ করার জোর ছিল না । বিমলও একরকম করে বুঝেছিল আমার উপর মেজোরানীর দাবি কেবলমাত্র সামাজিকতার দাবি নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর ; সেইজন্যে আমাদের এই আশৈশবের সম্পর্কটির পরে তার এতটা ঈর্ষা। আজ বুকের দরজাটার কাছে আমার হৃদয় ধকধক করে ঘা দিতে লাগল। একটা তেরঙ্গের উপর বসে পড়লুম ; বললুম, মেজোরানীদিদি, আমরা দুজনেই এই বাড়িতে যেদিন নতুন দেখা দিয়েছি সেইদিনের মধ্যে আর-একবার ফিরে যেতে বড়ো ইচ্ছে করে। মেজোরানী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, না ভাই মেয়েজন্ম নিয়ে আর নয় ! যা সয়েছি তা একটা জন্মের উপর দিয়েই যাক, ফের আর কি সয় ? আমি বলে উঠলুম, দুঃখের ভিতর দিয়ে যে মুক্তি আসে সেই মুক্তি দুঃখের চেয়ে বড়ো । তিনি বললেন, তা হতে পারে, ঠাকুরপো, তোমরা পুরুষমানুষ, মুক্তি তোমাদের জন্যে। আমরা মেয়েরা বাধতে চাই, বাধা পড়তে চাই ; আমাদের কাছ থেকে তোমরা সহজে ছাড়া পাবে না গো । ডানা যদি মেলতে চাও আমাদের সুন্ধু নিতে হবে, ফেলতে পারবে না। সেইজন্যেই তো এই সব বোঝা সাজিয়ে রেখেছি। তোমাদের একেবারে হালকা হতে দিলে কি আর রক্ষা আছে! মোট ভারী করি।- কখন বেরোতে হবে ঠাকুরপো ? ? রাত্তির সাড়ে এগারোটায়, সে এখনো ঢের সময় আছে। দেখাে ঠাকুরপাে, লক্ষ্মীটি, আমার একটি কথা রাখতে হবে, আজ সকাল-সকাল খেয়ে নিয়ে