পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܛܔܬ ܐܶ) সাধু হয়ে উঠেছি। অনুতাপের অশ্রুজল ফেলতে ফেলতে এই ছ হাজার টাকার গিনি ফিরিয়ে দেবার মতো ছিচকাদুনে সন্দীপ নয়। কিন্তু— এই বলে সন্দীপ কথাটা আর শেষ করলে না । একটু চুপ করে থেকে আমার দিকে চেয়ে বললে, মক্ষীরানী, এতদিন পরে সন্দীপের নির্মল জীবনে একটা কিন্তু এসে ঢুকেছে। রাত্রি তিনটের পর জেগে৷ উঠেই রোজ তার সঙ্গে একবার ঝুটােপুটি লড়াই করে দেখেছি সে নিতান্ত ফাকি নয়, তার দেনা চুকিয়ে না দিয়ে সন্দীপেরও নিস্কৃতি নেই। সেই আমার সর্বনাশিনী। কিন্তু'র হাতে দিয়ে গেলুম আমার পূজা । আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে দেখলুম। পৃথিবীতে কেবলমাত্র তারই ধন আমি নিতে পারব না— তোমার কাছে আমি নিঃস্ব হয়ে তবে বিদায় পাব দেবী ! এই নাও । বলে সেই গয়নার বাক্সটিও বের করে টেবিলের উপর রেখে সন্দীপ দ্রুত চলে যাবার উপক্ৰম করলে ! আমার স্বামী তাকে ডেকে বললেন, শুনে যাও, সন্দীপ । সন্দীপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললে, আমার সময় নেই নিখিল । খবর পেয়েছি মুসলমানের দল আমাকে মহামূল্য রত্বের মতো লুঠ করে নিয়ে তাদের গোরস্থানে পুঁতে রাখবার মতলব করেছে । কিন্তু আমার বেচে থাকার দরকার ; উত্তরের গাড়ি ছাড়তে আর পচিশ মিনিট মাত্র আছে। অতএব এখনকার মতো চললুম! তার পরে আবার একটু অবকাশ পেলে তোমাদের সঙ্গে বাকি সমস্ত কথা চুকিয়ে দেব | যদি আমার পরামর্শ নাও, তুমিও বেশি দেরি কোরো না ; মাক্ষীরানী, বন্দে প্রলয়রূপিণীং হৃদপিণ্ডমালিনীং । এই বলে সন্দীপ প্রায় ছুটে চলে গেল ! আমি স্তব্ধ হয়ে রইলুম । গিনি আর গয়নাগুলো যে কত তুচ্ছ সে আর-কোনোদিন এমন করে দেখতে পাই নি । কত জিনিস সঙ্গে নেব, কোথায় কী ধরাব, এই কিছু আগে তাই ভাবছিলুম, এখন মনে হল কোনো জিনিসই নেবার ৮৫, ৫ নেই— কেবল বেরিয়ে চলে যাওয়াটাই দরকার । আমার স্বামী চৌকি থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে বললেন, আর তো বেশি সময় নেহ, এখন কাজগুলো সেরে নেওয়া যাক । এমন সময় চন্দ্রনাথবাবু ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে ক্ষণকালের জনো সংকুচিত হলেন ; বললেন, মাপ কোরো মা, খবর দিয়ে আসতে পারি নি । নিখিল, মুসলমানের দল ক্ষেপে উঠেছে । হরিশ কুণ্ডুর কাছারি লুঠ হয়ে গেছে ; সেজন্যে ভয় ছিল না, কিন্তু মেয়েদের উপর তারা যে ৬, ৩, ১ < আরম্ভ করেছে। সে তো প্ৰাণ থাকতে সহ্য করা যায় না । আমার স্বামী বললেন, আমি তবে চললুম | আমি তার হাত ধরে বললুম, তুমি গিয়ে কী করতে পারবে ? মাস্টািরশমায়, আপনি ওকে বারণ করুন | চন্দ্রনাথবাবু বললেন, মা, বারণ করবার তো সময় নেই । আমার স্বামী বললেন, কিছু ভেবো না বিমল । জানলার কাছে গিয়ে দেখলুম, তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে চলে গেলেন । হাতে তার কোনো অস্ত্র ও छ्ळि न्नां । একটু পরে মেজোরানী ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকেই বললেন, করলি কী ছুটু, কী সর্বনাশ করলি ? বেহারিকে বললেন, ডাক ডাক, শিগগির দেওয়ানবাবুকে ডেকে আন | দেওয়ানবাবুর সামনে মেজোরানী কোনোদিন বেরোন নি । সেদিন তার লজ ছিল না । বললেন, মহারাজকে ফিরিয়ে আনতে শিগগির সওয়ার পাঠাও । দেওয়ানবাবু বললেন, আমরা সকলে মানা করেছি, তিনি ফিরবেন না । মেজোরানী বললেন, তাকে বলে পাঠাও, মেজোরানীর ওলাউঠে হয়েছে, তার মরণকাল আসন্ন । দেওয়ান চলে গেলে মেজোরানী আমাকে গাল দিতে লাগলেন, রাক্ষুসী, সর্বনাশী ! নিজে