পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য | 9và করিয়া দেখিলে তাহার অর্থ বিস্তৃততর, ভাব নিবিড়তর হইয়া উঠে। দান্তের কাব্যে দান্তের জীবন জড়িত হইয়া আছে, উভয়কে একত্রে পাঠ করিলে জীবন এবং কাব্যের মর্যাদা বেশি করিয়া দেখা | | টেনিসনের জীবন সেরূপ নহে। তাহা সংলোকের জীবন বটে, কিন্তু তাহা কোনাে অংশেই প্রশস্ত বৃহৎ বা বিচিত্ৰফলশালী নহে। তাহা তঁহার কাব্যের সহিত সমান ওজন রাখিতে পারে না। বরঞ্চ র্তাহার কাব্যে যে অংশে সংকীর্ণতা আছে, বিশ্ব-ব্যাপকতার অভাব আছে, আধুনিক বিলাতি সভ্যতার দোকান-কারখানার সদ্য গন্ধ কিছু অতিমাত্রায় আছে, জীবনীর মধ্যে সেই অংশের প্রতিবিম্ব পাওয়া যায়; কিন্তু যে ভাবে তিনি বিরাট, যে ভাবে তিনি মানুষের সহিত মানুষকে, সৃষ্টির সহিত সৃষ্টিকর্তকে একটি উদার সংগীতরাজ্যে সমগ্ৰ করিয়া দেখাইয়াছেন, তাহার সেই বৃহৎ ভাবটি জীবনীর মধ্যে আত্মপ্ৰকাশ করে নাই । আমাদের প্রাচীন ভারতবর্ষের কোনাে কবির জীবনচরিত নাই। আমি সেজন্য চিরকৌতুহলী, কিন্তু দুঃখিত নহি । বাল্মীকি সম্বন্ধে যে গল্প প্রচলিত আছে তাহাকে ইতিহাস বলিয়া কেহই গণ্য করবেন। না। কিন্তু আমাদের মতে তাঁহাই কবির প্রকৃত ইতিবৃত্ত। বাল্মীকির পাঠকগণ বাল্মীকির কাব্য হইতে যে জীবনচরিত সৃষ্টি করিয়া লইয়াছেন তাহা বাল্মীকির প্রকৃত জীবনের অপেক্ষা অধিক সত্য। কোন আঘাতে বাল্মীকির হৃদয় ভেদ করিয়া কাব্য-উৎস উচ্ছসিত হইয়াছিল ? করুণার আঘাতে । রামায়ণ করুণার অশ্রুনির্বর। ক্ৰৌঞ্চবিরহীর শোকার্ত ক্ৰন্দন রামায়ণকথার মর্মস্থলে ধ্বনিত হইতেছে। রাবণও ; ব্যাধের মতো প্রেমিকাযুগলকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়াছে, লঙ্কাকাণ্ডের যুদ্ধব্যাপার উন্মত্ত বিরহীর পাখার ঝটপট । রাবণ যে বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দিল মৃত্যুবিচ্ছেদের অপেক্ষাও তােহা ভয়ানক। মিলনের পরেও এ বিচ্ছেদের প্রতিকার হইল না । সুখের আয়োজনটি কেমন সুন্দর হইয়া আসিয়াছিল! পিতার স্নেহ, প্রজাদের গ্ৰীতি, ভ্রাতার প্রণয়, তাহারই মাঝখানে ছিল নবপরিণীত রামসীতার যুগলমিলন । যৌবরাজ্যের অভিষেক এই সুখসম্ভোগকে সম্পূর্ণ এবং মহীয়ান করিবার জন্যই উপস্থিত হইয়াছিল। ঠিক এমন সময়েই ব্যাধ শার লক্ষ করিল, সেই শর বিদ্ধ হইল সীতাহরণকালে । তাহার পরে শেষ পর্যন্ত বিরহের আর অন্ত রহিল না । দাম্পত্যসুখের নিবিড়তম আরম্ভের সময়েই দাম্পত্যসুখের দারুণতম অবসান । ক্ৰৌঞ্চমিথুনের গল্পটি রামায়ণের মূল ভাবটির সংক্ষিপ্ত রূপক। স্কুল কথা এই লোকে এই সত্যটুকু নিঃসন্দেহ আবিষ্কার করিয়াছে যে, মহাকবির নির্মল অনুষ্টুপছন্দঃপ্রবাহ করুণার উত্তাপেই বিগলিত হইয়া স্যন্দমান হইয়াছে, অকালে দাম্পত্যপ্রেমের চিরবিচ্ছেদ-ঘটনই ঋষির করুণান্দ্রি কবিত্বকে উন্মথিত করিয়াছে | আবার আর-একটি গল্প আছে, রত্নাকরের কাহিনী । সে আর-এক ভাবের কথা। রামায়ণের কাব্যপ্রকৃতির আর-এক দিকের সমালোচনা। এই গল্প রামায়ণের রামচরিত্রের প্রতি লক্ষ করিয়াছে। এই গল্পে বলিতেছে, রামসীতার বিচ্ছেদদুঃখের অপরিসীম করুণাই যে রামায়ণের প্রধান অবলম্বন তাহা নহে, রামচরিত্রের প্রতি ভক্তিই ইহার মূল। দসু্যকে কবি করিয়া তুলিয়াছে রামের এমন চরিত্র-ভক্তির এমন প্রবলতা ! রামায়ণের রাম যে ভারতবর্ষের চক্ষে কতবড়ো হইয়া দেখা দিয়াছেন এই গল্পে যেন তাহা মাপিয়া দিতেছে। এই দুটি গল্পেই বলিতেছে, প্রতিদিনের কথাবার্তা চিঠিপত্র দেখাসাক্ষাৎ কাজকর্মশিক্ষাদীক্ষার মধ্যে কবিত্বের মূল নাই ; তাহার মূলে একটি বৃহৎ আবেগের সঞ্চার, যেন একটি আকস্মিক অলৌকিক আবির্ভাবের মতে— তাহা কবির আয়ত্তের অতীত। কবিকঙ্কণ যে কাব্য লিখিয়াছেন তাহাও স্বপ্নে আদিষ্ট হইয়া, দেবীর প্রভাবে। কালিদাসের সম্বন্ধে যে গল্প আছে তাহাও এইরূপ। তিনি মুর্থ অরসিক ও বিদুষী স্ত্রীর পরিহাসভাজন ছিলেন। অকস্মাৎ দৈবপ্রভাবে তিনি কবিত্বরসে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিলেন। বাল্মীকি নিষ্ঠুর দস্য ছিলেন এবং কালিদাস অরসিক মুর্থ ছিলেন, এই উভয়ের একই তাৎপৰ্য। বাল্মীকির রচনায় 888