পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 eV) আশা কহিল, “তিনি যে তোমার মন জানেন, তাই খুশি হন। কিন্তু মনে করে, স্বামী যদি মুখের সেবায় খুশি না হন ।” অন্নপূর্ণ কহিলেন, “সকলকে খুশি করিবার শক্তি সকলের থাকে না, বাছা । স্ত্রী যদি আন্তরিক শ্রদ্ধাভক্তিযুত্বের সঙ্গে স্বামীর সেবা ও সংসারের কাজ করে, তবে স্বামী তাহা তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া দিলেও স্বয়ং জগদীশ্বর তাহা কুড়াইয়া লন।” আশা নিরুত্তরে চুপ করিয়া রহিল। মাসির এই কথা হইতে সাৰনা গ্রহণের অনেক চেষ্টা করিল, কিন্তু স্বামী যাহাকে তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া দিবেন, জগদীশ্বরও যে তাহাকে সার্থকতা দিতে পারিবেন, এ-কথা কিছুতেই তাহার মনে লইল না । সে নতমুখে বসিয়া তাহার মাসির পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল । অন্নপূর্ণ তখন আশার হাত ধরিয়া তাহাকে আরো কাছে টানিয়া লইলেন ; তাহার মস্তকচুম্বন করিলেন ; রুদ্ধকণ্ঠকে দৃঢ়চেষ্টায় বাধামুক্ত করিয়া কহিলেন, "চুনি, দুঃখে কষ্টে যে-শিক্ষালাভ হয় শুধু কানে শুনিয়া তাহ পাইবি না। তোর এই মাসিও একদিন তোর বয়সে তোরি মতো সংসারের সঙ্গে মস্ত করিয়া দেনাপাওনার সম্পর্ক পাতিয়া বসিয়াছিল । তখন আমিও তোরই মতো মনে করিতাম, যাহার সেবা করিব তাহার সন্তোষ না জন্মিবে কেন। যাহার পূজা করিব তাহার প্রসাদ না পাইব কেন । যাহার ভালোর চেষ্টা করিব, সে আমার চেষ্টাকে ভালো বলিয়া না বুঝিবে কেন । পদে পদে দেখিলাম, সেরূপ হয় না। অবশেষে একদিন অসহ হইয়া মনে হইল, পৃথিবীতে আমার সমস্তই ব্যর্থ হইয়াছে— সেইদিনই সংসার ত্যাগ করিয়া আসিলাম । আজ দেখিতেছি, আমার কিছুই নিষ্ফল হয় নাই। ওরে বাছা, যার সঙ্গে আসল দেনাপাওনার সম্পর্ক, যিনি এই সংসার-হাটের মূল মহাজন, তিনিই আমার সমস্তই লইতেছিলেন, হৃদয়ে বসিয়া আজ সে-কথা স্বীকার করিয়াছেন। তখন যদি জানিতাম ! যদি তার কর্ম বলিয়া সংসারের কর্ম করিতাম, তাকে দিলাম বলিয়াই সংসারকে হৃদয় দিতাম, তা হইলে কে আমাকে দুঃখ দিতে পারিত।” আশা বিছানায় শুইয়া শুইয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত অনেক কথা ভাবিল, তবু ভালো করিয়া কিছুই বুঝিতে পারিল না। কিন্তু পুণ্যবতী মাসির প্রতি তাহার অসীম ভক্তি ছিল, সেই মাসির কথা সম্পূর্ণ না বুঝিলেও একপ্রকার শিরোধার্ঘ করিয়া লইল । মাসি সকল সংসারের উপরে যাহাকে হৃদয়ে স্থান দিয়াছেন, তাহার উদ্দেশে অন্ধকারে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া গড় করিয়া প্রণাম করিল। বলিল, “আমি বালিকা, তোমাকে জানি না, আমি কেবল আমার স্বামীকে জানি, সেজন্য অপরাধ লইয়ো না। আমার স্বামীকে আমি যে পূজা দিই ভগবান, তুমি তাহাকে তাহা গ্রহণ করিতে বলিয়ে।