পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে §e& শাস্ত্রে আছে, এক বললেন, বহু হব । নানার মধ্যে এক আপন ঐক্য উপলব্ধি করতে চাইলেন। একেই বলে স্বষ্টি । অামাতে যে-এক আছে সেও নিজেকে বছর মধ্যে পেতে চায় ; উপলব্ধির ঐশ্বৰ্ধ সেই তার বহুলত্বে । আমাদের চৈতন্তে নিরস্তর প্রবাহিত হচ্ছে বছর ধারা, রূপে রসে নানা ঘটনার তরঙ্গে ; তারই প্রতিঘাতে স্পষ্ট করে তুলছে ‘আমি আছি' এই বোধ। আপনার কাছে আপনার প্রকাশের এই স্পষ্টতাতেই আনন্দ । অস্পষ্টতাতেই অবসাদ । একলা কারাগারের বন্দীর আর-কোনো পীড়ন যদি নাও থাকে তবু আবছায়া হয়ে জাসে তার আপনার বোধ, সে ষেন নেই-হওয়ার কাছাকাছি আসে। ‘আমি আছি এবং ন-আমি আছে’ এই দুই নিরস্তর ধারা আমার মধ্যে ক্রমাগতই একীভূত হয়ে আমাকে স্বষ্টি করে চলেছে ; অন্তর-বাহিরের এই সম্মিলনের বাধায় আমার আপনস্বাক্টকে কৃশ বা বিকৃত ক’রে দিলে নিরানন্দ ঘটায়। এইখানে তর্ক উঠতে পারে যে, আমির সঙ্গে না-আমির মিলনে দুঃখেরও তো উদ্ভব হয় । তা হতে পারে । কিন্তু, এটা মনে রাখা চাই যে, স্বখেরই বিপরীত দুঃখ, কিন্তু আনন্দের বিপরীত নয় ; বস্তুভ দুঃখ আনন্দেরই অন্তভূত। কথাটা শুনতে স্বতোবিরুদ্ধ কিন্তু সত্য । যা হোক, এ আলোচনাটা আপাতত থাক, পরে হবে। আমাদের জানা দু-রকমের, জ্ঞানে জানা আর অমুভবে জানা । অমুভব শব্দের ধাতুগত অর্থের মধ্যে আছে অন্ত-কিছুর অনুসারে হয়ে ওঠা ; শুধু বাইরে থেকে সংবাদ পাওয়া নয়, অন্তরে নিজেরই মধ্যে একটা পরিণতি ঘটা। বাইরের পদার্থের যোগে কোনো বিশেষ রঙে বিশেষ রসে বিশেষ রূপে আপনাকেই বোধ করাকে বলে অনুভব করা। সেইজন্তে উপনিষদ বলেছেন, পুত্রকে কামনা করি বলেই যে পুত্র আমাদের প্রিয় তা নয়, আপনাকেই কামনা করি বলেই পুত্র আমাদের প্রিয় । পুত্রের মধ্যে পিতা নিজেকেই উপলব্ধি করে, সেই উপলব্ধিতেই আনন্দ । আমরা যাকে বলি সাহিত্য, বলি ললিতকলা, তার লক্ষ্য এই উপলব্ধির আনন্দ, বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ী এক হয়ে যাওয়াতে যে-আনন্দ । অমুস্তৃতির গভীরতা দ্বারা বাহিরের সঙ্গে অস্তরের একাত্মবোধ যতটা সত্য হয় সেই পরিমাণে জীবনে আনন্দের সীমানা বেড়ে চলতে থাকে, অর্থাৎ নিজেরই সত্তার সীমানা। প্রতিদিনের ব্যবহারিক ব্যাপারে ছোটো ছোটো ভাগের মধ্যে আমাদের আত্মপ্রসারণকে অবরুদ্ধ করে, মনকে বেঁধে রাখে বৈষয়িক সংকীর্ণভায়, প্রয়োজনের সংসারটা আমাদের আপনাকে ঘিরে রাখে কড়া পাহারায় ; অবরোধের নিত্য অভ্যাসের জড়তায় ভুলে যাই যে, নিছক বিষয়ী মানুষ অত্যন্তই কম মাহুষ— সে প্রয়োজনের কাচি-ছাট মাস্থ্য।