পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ brbr রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকতে পারে, আমার স্পষ্টই মনে আছে যে, আমার এই সকল কথায় দেশের লোক বিষম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। যারা কটুভাযা-ব্যবসায়ী সাহিত্যিক গুণ্ডা আমি তাদের কথা বলছি নে, কিন্তু গণ্যমান্য এবং শিষ্টশান্ত ব্যক্তিরাও আমার সম্বন্ধে ধৈর্য রক্ষা করতে পারেন নি । এর দুটি মাত্র কারণ ; প্রথম- ক্ৰোধ, দ্বিতীয়- লোভ । ক্রোধের তৃপ্তিসাধন হচ্ছে এক রকমের ভোগসুখ ; সেদিন এই ভোগসুখের মাতলামিতে আমাদের বাধা অতি অল্পই ছিল- আমরা মনের আনন্দে কাপড় পুড়িয়ে বেড়াচ্ছি, পিকেটি করছি, যারা আমাদের পথে চলছিল না। তাদের পথে কাটা দিচ্ছি এবং ভাষায় আমাদের কোনো আবু রাখছি নে । এইসকল অমিতাচারের কিছুকাল পরে একজন জাপানি আমাকে একদিন বলেছিলেন, “তোমরা নিঃশব্দে দৃঢ় এবং গৃঢ় ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করতে পার না কেন । কেবলই শক্তির বাজে খরচ করা তো উদ্দেশ্যসাধনের সদুপায় নয় ।” তার জবাবে সেই জাপানিকে আমার বলতে হয়েছিল যে, “উদ্দেশ্যসাধনের কথাটাই যখন আমাদের মনে উজ্জ্বল থাকে তখন মানুষ স্বভাবতই আত্মসংযম করে নিজের সকল শক্তিকেই সেই দিকে নিযুক্ত করে । কিন্তু ক্রোধের তৃপ্তিসাধন যখন মত্ততার সপ্তকে সপ্তকে উদ্দেশ্যসাধনকে ছাড়িয়ে উঠতে থাকে তখন শক্তিকে খরচ করে দেউলে হতে আমাদের বাধা থাকে না ।” যাই হােক সেদিন ঠিক যে সময়ে বাঙালি কিছুকালের জন্যে ক্ৰোধতৃপ্তির সুখভোগে বিশেষ বিষ্ম পাচ্ছিল না, সমস্তই যেন একটা আশ্চর্য স্বপ্নের মতো বোধ হচ্ছিল, সেই সময়ে তাকে অন্য পথের কথা বলতে গিয়ে আমি তার ক্রোধের ভাজন হয়েছিলেম । তা ছাড়া আরো একটি কথা ছিল, সে হচ্ছে লোভ । ইতিহাসে সকল জাতি দুৰ্গম পথ দিয়ে দুর্লভ জিনিস পেয়েছে, আমরা তার চেয়ে অনেক সস্তায় পাব- হাত-জোড়-করা ভিক্ষের দ্বারা নয়, চোখ-রাঙানো ভিক্ষের দ্বারা পাব, এই ফন্দির আনন্দে সেদিন দেশ মেতেছিল । ইংরেজ দোকানদার যাকে বলে reduced price sale, সেদিন যেন ভাগ্যের হাটে বাঙালির কপালে পোলিটিকাল মালের সেইরকম সস্তা দামের মৌসুম পড়েছিল । যার সম্বল কম, সস্তার নাম শোনাবামাত্র সে এত বেশি খুশি হয়ে ওঠে যে, মালটা যে কী আর তার কী অবস্থা তার খোজ রাখে না, আর যে ব্যক্তি সন্দেহ প্ৰকাশ করে তাকে তেড়ে মারতে যায় । মোট কথা সেদিনও আমাদের লক্ষ্য ছিল, ধ্যান ছিল, ঐ বাইরের মায়াটা নিয়ে । তাই তখনকার কালের একজন নেতা বলেছিলেন, আমার এক হাত ইংরেজ সরকারের টুটিতে, আর-এক হাত তার পায়ে । অর্থাৎ কোনো হাতই বাকি ছিল না দেশের জন্য । তৎকালে এবং তার পরবতী কালে এই দ্বিধা হয়তো অনেকের একেবারে ঘুচে গেছে, এক দলের দুই হাতই হয়তো উঠেছে। সরকারের টুটিতে আর-এক দলের দুই হাতই হয়তো নেমেছে। সরকারের পায়ে, কিন্তু মায়া থেকে মুক্তিসাধনের পক্ষে দুইই হচ্ছে বাইরের পথ । হয় ইংরেজ সরকারের দক্ষিণে নয় ইংরেজ সরকারের বামে পোড়া মন ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার হাই বল আর নাই বল দুইই হচ্ছে ইংরেজকে নিয়ে । সেদিন চারি দিক থেকে বাংলাদেশের হৃদয়াবেগের উপরেই কেবল তাগিদ এসেছে। কিন্তু শুধু হৃদয়াবেগ আগুনের মতো জ্বালানি বস্তুকে খরচ করে, ছাই করে ফেলে- সে তো সৃষ্টি করে না । মানুষের অন্তঃকরণ ধৈর্যের সঙ্গে, নৈপুণ্যের সঙ্গে, দূরদৃষ্টির সঙ্গে এই আগুনে কঠিন উপাদানকে গলিয়ে আপনার প্রয়োজনের সামগ্ৰীকে গড়ে তুলতে থাকে । দেশের সেই অন্তঃকরণকে সেদিন জাগানো হল না, সেইজন্যে এত বড়ো একটা হৃদয়া বেগ থেকে কোনো একটা স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারল না । এমনটা যে হল তার কারণ বাইরে নেই, তার কারণ আছে আমাদের নিজেরই ভিতরে । অনেক দিন থেকেই আমাদের ধর্মে কর্মে এক দিকে আছে হৃদয়াবেগ, আর-এক দিকে আছে। অভ্যস্ত আচার । আমাদের অন্তঃকরণ অনেক দিন থেকে কোনো কাজ করে নি ; তাকে ভয়ে ভয়ে চেপে রাখা হয়েছে। এইজন্যে যখন আমাদের কাছ থেকে কোনো কাজ আদায় করার দরকার পড়ে তখন তাড়াতাড়ি হৃদয়াবেগের উপর বরাত দিতে হয় এবং নানারকম জাদুমন্ত্র আউড়িয়ে মনকে মুগ্ধ করবার প্রয়োজন ঘটে । অর্থাৎ সমস্ত দেশ জুড়ে এমন একটা অবস্থা উৎপাদন করা হয় যেটা অন্তঃকরণের কাজ করার পক্ষে বিষম প্রতিকূল । অন্তঃকরণের জড়তায় যে ক্ষতি সে ক্ষতিকে কোনো কিছুতেই পূরণ করা যায় না । কোনোমতে