পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \ኃ(፩ (፩ নিকট যদি বিভার কোনো আদর থাকিত, তবে তাহারা বিভাকে লইতে নিজে হইতে লোক পাঠাইত । আমাদের অত ব্যস্ত হইবার আবশ্যক দেখি না ।” রাজমহিষী বিভাকে দেখিয়া কান্নাকাটি করেন । বিভার সধবা অবস্থায় বৈধব্য কি চোখে দেখা যায় ? বিভার করুণ মুখখানি দেখিলে তাহার প্রাণে শেল বাজে । তাহা ছাড়া মহিষী তাহার জামাতাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন, সে একটা কী ছেলেমানুষী করিয়াছে বলিয়া তাহার ফল যে এতদূর পর্যন্ত হইবে, ইহা তাহার কিছুতেই ভালো লাগে নাই । তিনি মহারাজের কাছে গিয়া মিনতি করিয়া বলিলেন, “মহারাজ, বিভাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাও।” মহারাজ রাগ করিলেন, কহিলেন, “ঐ এক কথা আমি অনেকবার শুনিয়াছি, আর আমাকে বিরক্ত করিয়ো না । যখন তাহারা বিভাকে ভিক্ষা চাহিবে, তখন তাহারা বিভাকে পাইবে।” মহিষী কহিলেন, “মেয়ে অধিক দিন শ্বশুরবাড়ি না গেলে দশজনে কী বলিবে ?” প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “আর প্রতাপাদিত্য নিজে সাধিয়া যদি মেয়েকে পাঠায় আর রামচন্দ্ৰ রায় যদি তাহাকে দ্বার হইতে দূর করিয়া দেয়, তাহা হইলেই বা দশজনে কী বলিবে ?” মহিষী কঁদিতে কঁদিতে ভাবিলেন, মহারাজ এক-এক সময় কী যে করেন তাহার কোনো ঠিকানা থাকে না । উনবিংশ পরিচ্ছেদ মান অপমানের প্রতি রাজা রামচন্দ্র রায়ের অত্যন্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টি । রাজা একদিন চতুৰ্দোলায় করিয়া রাস্তায় বাহির হইয়াছিলেন, দুইজন অনভিজ্ঞ তাতি তাঁহাদের কুটিরের সম্মুখে বসিয়া তাত বুনিতেছিল, চতুৰ্দোল দেখিয়া উঠিয়া দাড়ায় নাই, রাজা তাহা লইয়া হুলুস্কুল করিয়া তুলিয়াছিলেন । একবার যশোহরে তাহার শ্বশুরবাড়ির এক চাকরকে তিনি একটা কী কাজের জন্য আদেশ করিয়াছিলেন, সে বেচারা এক শুনিতে আর শুনিয়াছিল, কাজে ভুল করিয়াছিল, মহামনী রামচন্দ্র রায় তাহা হইতে সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, শ্বশুরবাড়ির ভূত্যেরা তাহাকে মানে না । তাহারা অবশ্য তাহাদের মনিবন্দের কাছেই এইরূপ শিখিয়াছে নহিলে তাহারা সাহস করিত না । বিশেষত সেইদিন প্ৰাতঃকালেই তিনি দেখিয়াছিলেন যুবরাজ উদয়াদিত্য সেই চাকরকে চুপি চুপি কী একটা কথা বলিতেছিলেন— অবশ্য তাহাকে অপমান করিবার পরামর্শই চলিতেছিল, নহিলে আর কী হইতে পারে । একদিন কয়েকজন বালক মাটির ঢিপির সিংহাসন গড়িয়া, রাজা, মন্ত্রী ও সভাসদ সাজিয়া রাজসভার অনুকরণে খেলা করিতেছিল । রাজার কানে যায়, তিনি তাহাদের পিতাদের ডাকিয়া বিলক্ষণ শাসন করিয়া দেন । আজ মহারাজা গদির উপরে তাকিয়া ঠেসান দিয়া গুড়গুড়ি টানিতেছেন । সম্মুখে এক ভীরু দরিদ্র অপরাধী খাড়া রহিয়াছে, তাহার বিচার চলিতেছে। সে ব্যক্তি কোনো সূত্রে প্রতাপাদিত্য ও রামচন্দ্ৰ রায় সংক্রান্ত ঘটনা শুনিতে পায় ও তাহা লইয়া আপনা-আপনির মধ্যে আলোচনা করে, তাহাই শুনিয়া তাহার শত্রুপক্ষের একজন সে কথাটা রাজার কানে উত্থাপন করে । রাজা মহা, খাপা হইয়া তাহাকে তলব করেন । তাহাকে ফসিই দেন কি নির্বাসনই দেন, এমনি একটা কাণ্ড বাধিয়া গেছে। রাজা বলিতেছেন, “বেটা, তোর এতবড়ো যোগ্যতা !” সে কঁাদিয়া কহিতেছে, “দোহাই মহারাজ, আমি এমন কাজ করি নাই ।” দেওয়ান কহিতেছেন, “বেটা, জনিস না, যখন প্রতাপাদিত্যের বাপ প্রথম রাজা হয়, তাহাকে রাজটিকা পরাইবার জন্য সে আমাদের মহারাজার স্বগীয় পিতামহের কাছে আবেদন করে । অনেক কাদাকাটা করাতে তিনি তাহার বা পায়ের কড়ে আঙুল দিয়া তাহাকে টিকা পরাইয়া দেন।” রামাই ভাড় কহিতেছে, “বিক্রমাদিত্যের ছেলে প্রতাপাদিত্য, উহারা তো দুই পুরুষে রাজা । প্রতাপাদিত্যের পিতামহ ছিল কেঁচো, কেঁচাের পুত্ৰ হইল জোক, বেটা প্রজার রক্ত খাইয়া খাইয়া বিষম ফুলিয়া উঠিল, সেই জোকের পুত্র আজ মাথা খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া মাথাটা কুলোপনা করিয়া তুলিয়াছে ও