পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ8Տ চতুবিংশ পরিচ্ছেদ খুড়াসাহেবের হাত এড়াইতে সুচেতসিংহকে আর অধিক প্ৰয়াস পাইতে হইল না। কাল প্রাতে বন্দী-সমেত সম্রাট-সৈন্যের যাত্রার দিন স্থির হইয়াছে, যাত্রার আয়ােজনে সৈন্যেরা নিযুক্ত হইল। হইতে আমার আলবোলাটা আনিয়া দিবে, তাহাও ইহাদের মনে উদয় হইল না।” বিজয়গড়ের পাহাড়ের নিম্নভাগে এক গভীর খাল আছে। সেই খালের ধারে এক স্থানে একটি বজদগ্ধ অশথের গুড়ি আছে। সেই গুড়ির কাছ-বরাবর রঘুপতি গভীর রাত্রে ডুব দিলেন ও অদৃশ্য হইয়া গেলেন । গোপনে দুর্গ-প্রবেশের জন্য যে সুরঙ্গ-পথ আছে। এই খালের গভীর তলেই তাহার প্রবেশের মুখ । এই পথ বাহিয়া সুরঙ্গ-প্রান্তে পৌঁছিয়া নীচে হইতে সবলে ঠেলিলেই একটি পাথর উঠিয়া পড়ে, উপর হইতে তাহাকে কিছুতেই উঠানো যায় না । সুতরাং যাহারা দুর্গের ভিতরে আছে তাহারা এ পথ দিয়া বাহির হইতে পারে না । বন্দীশালার পালঙ্কের উপরে সুজা নিদ্রিত। পালঙ্ক ছাড়া গৃহে আর-কোনো সজ্জা নাই। একটি প্ৰদীপ জ্বলিতেছে। সহসা গৃহে ছিদ্র প্রকাশ পাইল । অল্পে অল্পে মাথা তুলিয়া পাতাল হইতে রঘুপতি উঠিয়া পড়িলেন । র্তাহার সর্বাঙ্গ ভিজা । সিক্ত বস্ত্ৰ হইতে জলধারা ঝরিয়া পড়িতেছে। রঘুপতি ধীরে ধীরে সুজাকে স্পর্শ করিলেন । AO সুজা চমকিয়া উঠিয়া চক্ষু রাগড়াইয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলেন, তার পরে আলস্যজড়িত স্বরে কহিলেন, “কী হাঙ্গাম! ইহারা কি আমাকে রাত্রেও ঘুমাইতে দিবে না ! তােমাদের ব্যবহারে আমি আশ্চর্য হইয়াছি।” রঘুপতি মৃদুস্বরে কহিলেন, “শাহাজাদা, উঠিতে আজ্ঞা হউক । আমি সেই ব্ৰাহ্মণ । আমাকে স্মরণ করিয়া দেখুন। ভবিষ্যতেও আমাকে স্মরণ রাখিবেন।” পরদিন প্রাতে সম্রাট-সৈন্য যাত্রার জন্য প্ৰস্তুত হইল। সুজাকে নিদ্রা হইতে জগাইবার জন্য রাজা জয়সিংহ স্বয়ং বন্দীশালায় প্রবেশ করিলেন । দেখিলেন, সুজা তখনো শয্যা হইতে উঠেন নাই। কাছে গিয়া স্পর্শ করিলেন। দেখিলেন, সুজা নহে, তাহার বস্ত্ৰ পড়িয়া আছে। সুজা নাই। ঘরের মেঝের মধ্যে সুরঙ্গ-গহবর, তাহার প্রস্তর-আবরণ উন্মুক্ত পড়িয়া আছে। বন্দীর পলায়নবার্তা দুর্গে রাষ্ট্র হইল। সন্ধানের জন্য চারিদিকে লোক ছুটিল। রাজা বিক্রমসিংহের শির নত হইল। বন্দী কিরূপে পলাইল তাহার বিচারের জন্য সভা বসিল । খুড়াসাহেবের সেই গর্বিত সহর্ষভােব কোথায় গেল ! তিনি পাগলের মতো ‘ব্রাহ্মণ কোথায় ‘ব্রাহ্মণ কোথায় করিয়া রঘুপতিকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন। ব্ৰাহ্মণ কোথাও নাই। পাগড়ি খুলিয়া খুড়াসাহেব কিছুকাল মাথায় হাত দিয়া বসিয়া রহিলেন । সুচেতসিংহ পাশে আসিয়া বসিলেন ; কহিলেন, "খুড়াসাহেব, কী আশ্চৰ্য্য কারখানা ! এ কি সমস্ত ভূতের কাণ্ড !” খুড়াসাহেব বিষন্ন ভাবে ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “না, এ ভূতের কাণ্ড নয় সুচেতসিংহ, এ একজন নিতান্ত নির্বোিধ বৃদ্ধের কাণ্ড ও আর-একজন বিশ্বাসঘাতক পাষণ্ডের কাজ ।” সুচেতসিংহ আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “তুমি যদি তাঁহাদের জানোই তবে তাঁহাদের গ্রেফতার করিয়া ९3-ञ्षी कन् ?” খুড়াসাহেব কহিলেন, “তাহাদের মধ্যে একজন পালাইয়াছে। আর-একজনকে গ্রেফতার করিয়া রাজসভায় লইয়া যাইতেছি।” বলিয়া পাগড়ি পরিলেন ও রাজসভার বেশ ধারণ করিলেন । সভায় তখন প্রহরীদের সাক্ষ্য লওয়া হইতেছিল। খুড়াসাহেব নতশিরে সভায় প্রবেশ করিলেন ।