পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br88 রবীন্দ্র-রচনাবলী বেশ বদল করে শয়নের উদ্যোগ করবার সময় দেখা গেল আমাদের জিনিসপত্রের মধ্যে আর-একজনের ওভারকোটি গাত্রবস্ত্র । আমরা তিনজনেই পরস্পরের জিনিস চিনি নে ; সুতরাং হাতের কাছে যে-কোনো অপরিচিত বস্ত্র পাওয়া যায়। সেইটেই আমাদের কারো-না-কারো স্থির করে অসংশয়ে ংগ্রহ করে আনি । অবশেষে নিজের নিজের জিনিস পৃথক করে নেবার পর উদ্যবৃত্ত সামগ্ৰী পাওয়া গেলে, তা আর পূর্বাধিকারীকে ফিরিয়ে দেবার কোনো সুযোগ থাকে না। ওভারকেটটি রেলগাড়ি থেকে আনা হয়েছে ; যার কোট সে বেচারা বিশ্বস্তচিত্তে গভীর নিদ্রায় মগ্ন । গাড়ি এতক্ষণে সমুদ্রতীরস্থ ক্যালে নগরীর নিকটবতী হয়েছে। লোকটি কে, এবং সমস্ত ব্রিটিশ রাজ্যের মধ্যে তার ঠিকানা কোথায়, আমরা কিছুই জানি নে । মাঝের থেকে তার লম্বা কুর্তি এবং আমাদের পাপের ভার স্কন্ধের উপর বহন করে বেড়াচ্ছি— প্ৰায়শ্চিত্তের পথ বন্ধ। মনে হচ্ছে একবার যে লোকটির কম্বল হরণ করেছিলুম এ কুর্তিটিও তার । সে বেচারা বৃদ্ধ শীতপীড়িত, বাতে পঙ্গু, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পুলিস-অধ্যক্ষ । পুলিসের কাজ করে মানবচরিত্রের প্রতি সহজেই তার বিশ্বাস শিথিল হয়ে এসেছে, তার পরে যখন কাল প্ৰত্যুষে ব্রিটিশ চ্যানেল পার হবার সময় তীব্র শীতবায়ু তার হৃতকুর্তি জীর্ণ দেহকে কম্পান্বিত করে তুলবে তখন সেইসঙ্গে মনুষ্যজাতির সাধুতার প্রতিও তার বিশ্বাস কম্পিত হতে থাকবে । ৯ সেপ্টেম্বর ৷ প্ৰাতঃকালে দ্বিতীয়বার বেশপরিবর্তন করবার সময় দেখা গেল আমার বন্ধুর একটি পোটম্যাণ্টো পাওয়া যাচ্ছে না । পুলিসে সংবাদ দিয়ে প্রাতঃকালে তিনজনে প্যারিসের পথে পদব্রজে বেরিয়ে পড়লুম। প্রকাণ্ড রাজপথ দোকান বাগান প্রাসাদ প্রস্তরমূর্তি ফোয়ারা লোকজন গাড়িঘোড়ার মধ্যে অনেক ঘুরে ঘুরে এক ভোজন-গৃহের বিরাট স্ফটিকশালার প্রান্তটেবিলে বসে অল্প আহার করে এবং বিস্তর মূল্য দিয়ে ঈফেল স্তম্ভ দেখতে গেলেম । এই লৌহস্তম্ভ চারি পায়ের উপরে ভর দিয়ে এক বাগানের মাঝখানে দাড়িয়ে আছে । কলের দোলায় চড়ে এই স্তম্ভের চতুর্থ তলায় উঠে নিম্নে সমস্ত প্যারিসটাকে খুব একটা বড়ো ম্যাপের মতো প্রসারিত দেখতে পেলুম | বলা বাহুল্য, এমন করে একদিনে তাড়াতাড়ি চক্ষুদ্বারা বহির্ভাগ লেহন করে প্যারিসের রসাস্বাদন করা যায় না । এ যেন, ধনিগৃহের মেয়েদের মতো বদ্ধ পালকির মধ্যে থেকে গঙ্গাস্নান করার মতো— কেবল নিতান্ত তীরের কাছে একটা অংশে এক ডুবে যতখানি পাওয়া যায়। কেবল হাঁপানিই সার । হােটেলে এসে দেখলুম পুলিসের সাহায্যে বন্ধুর পোর্টম্যান্টো ফিরে এসেছে, কিন্তু এখনো সেই পরের হৃত কোর্তা সম্বন্ধে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছি। ১০ সেপ্টেম্বর । লন্ডন অভিমুখে চললুম। সন্ধ্যার সময় লন্ডনে পৌঁছে দুই-একটি হােটেল অন্বেষণ করে দেখা গেল স্থানাভাব । অবশেষে একটি ভদ্রপরিবারের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করা গেল । ১১ সেপ্টেম্বর । সকালবেলায় আমাদের পুরাতন বন্ধুদের সন্ধানে বাহির হওয়া গেল । প্ৰথমে লন্ডনের মধ্যে আমার সর্বাপেক্ষা পরিচিত বাড়ির দ্বারে গিয়ে আঘাত করা গেল । যে দাসী এসে দরজা খুলে দিলে তাকে চিনি নে । তাকে জিজ্ঞাসা করলুম। আমার বন্ধু বাড়িতে আছেন কি না । সে বললে তিনি এ-বাড়িতে থাকেন না । জিজ্ঞাসা করলুম, কোথায় থাকেন ? সে বললে, আমি জানি নে, আপনারা ঘরে এসে বসুন, আমি জিজ্ঞাসা করে আসছি। পূর্বে যে-ঘরে আমরা আহার করতুম সেই ঘরে গিয়ে দেখলেম সমস্ত বদল হয়ে গেছে- সেখানে টেবিলের উপর খবরের কাগজ এবং বই- সে-ঘর এখন অতিথিদের প্রতীক্ষাশালা হয়েছে। খানিকক্ষণ বাদে দাসী একটি কার্ডে লেখা ঠিকানা এনে দিলে। আমার বন্ধু এখন লন্ডনের বাইরে কোন এক অপরিচিত স্থানে থাকেন। নিরাশহীদয়ে আমার সেই পরিচিত বাড়ি থেকে বেরোলুম। আমাদের গাড়ি মিস শ-এর বাড়ির সম্মুখে এসে দাঁড়াল। গিয়ে দেখি তিনি নির্জন গৃহে বসে একটি পীড়িত কুকুরশাবকের সেবায় নিযুক্ত। জলবায়ু, পরস্পরের স্বাস্থ্য এবং কালের পরিবর্তন সম্বন্ধে কতকগুলি প্ৰচলিত শিষ্টালাপ করা গেল ।