পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& > br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী জীবনে সুগঠনে মণ্ডিত করিয়া, খাড়া করিয়া তুলেন । বড়ো বড়ো লোকেরা যে বড়ো বড়ো কাজ করেন সেও এই ভাবে । যেখানকার যেটি সে যেন একটি দৈবশক্তিপ্রভাবে আকৃষ্ট হইয়া রেখায় রেখায় বর্ণে বর্ণে মিলিয়া যায়, একটি সুসম্পন্ন সুসম্পূর্ণ কাৰ্যরূপে দাড়াইয়া যায়। প্রকৃতির সর্বকনিষ্ঠজাত মন-নামক দুরন্ত বালকটি যে একেবারে তিরস্কৃত বহিস্কৃত হয় তাহা নহে, কিন্তু সে তদপেক্ষা উচ্চতর মহত্তর প্রতিভার অমোঘমায়ামন্ত্রবলে মুগ্ধের মতো কাজ করিয়া যায় ; মনে হয় সমস্তই যেন জাদুতে হইতেছে ; যেন সমস্ত ঘটনা, যেন বাহ্য অবস্থাগুলিও, যোগবলে যথেচ্ছামত যথাস্থানে বিন্যস্ত হইয়া যাইতেছে । গারিবান্ডি এমনি করিয়া ভাঙাচোরা ইটালিকে নূতন করিয়া প্রতিষ্ঠা করেন, ওয়াশিংটন অরণ্যপর্বতবিক্ষিপ্ত আমেরিকাকে আপনার চারি দিকে টানিয়া আনিয়া একটি সাম্রাজ্যরূপে গড়িয়া দিয়া যান । এই-সমস্ত কার্য এক-একটি যোগসাধন । কবি যেমন কাব্য গঠন করেন, তানসেন যেমন তান লয় ছন্দে এক-একটি গান সৃষ্টি করিতেন, রমণী তেমনি আপনার জীবনটি রচনা করিয়া তোলে । তেমনি অচেতনভাবে, তেমনি মায়ামন্ত্রবলে । পিতাপুত্ৰ ভ্ৰাতাভগ্ৰী অতিথিঅভ্যাগতকে সুন্দর বন্ধনে বঁাধিয়া সে আপনার চারি দিকে গঠিত সজ্জিত করিয়া তোলে ; বিচিত্র উপাদান লইয়া বড়ো সুনিপুণ হস্তে একখানি গৃহ নির্মাণ করে ; কেবল গৃহ কেন, রমণী যেখানে যায় আপনার চারি দিককে একটি সৌন্দৰ্যসংযমে বাধিয়া আনে । নিজের চলাফেরা বেশভূষা কথাবার্তা আকার-ইঙ্গিতকে একটি অনির্বচনীয় গঠন দান করে । তাঁহাকে বলে শ্ৰী । ইহা তো বুদ্ধির কাজ নহে, অনিৰ্দেশ্য প্রতিভার কােজ ; মনের শক্তি নহে, আত্মার অভ্রান্ত নিগৃঢ় শক্তি । এই যে ঠিক সুরটি ঠিক জায়গায় গিয়া লাগে, ঠিক কথাটি জায়গায় আসিয়া বসে, ঠিক কাজটি ঠিক সময়ে নিম্পন্ন হয়— ইহা একটি মহারহস্যময় নিখিলজগৎকেন্দ্ৰভূমি হইতে স্বাভাবিক স্ফটিকধারার ন্যায় উচ্ছসিত উৎস ৷ সেই কেন্দ্ৰভূমিটিকে অচেতন না বলিয়া অতিচেতন নাম দেওয়া উচিত । প্রকৃতিতে যাহা সৌন্দর্য, মহৎ ও গুণী লোকে তাহাই প্রতিভা, এবং নারীতে তাহাই শ্ৰী, তাই নারীত্ব । ইহা কেবল পাত্ৰভেদে ভিন্ন বিকাশ । অতঃপর ব্যোম সমীরের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল— তার পরে ? তোমার লেখাটা শেষ করিয়া ফেলো । সমীর কহিল— আর আবশ্যক কী ? আমি যাহা আরম্ভ করিয়াছি। তুমি তো তাহার একপ্রকার উপসংহার করিয়া দিয়াছ । ক্ষিতি কহিল- কবিরাজ মহাশয় শুরু করিয়াছিলেন, ডাক্তার মহাশয় সাঙ্গ করিয়া গেলেন, এখন আমরা হরি হরি বলিয়া বিদায় হই। মন কী, বুদ্ধি কী, আত্মা কী, সৌন্দর্য কী এবং প্রতিভাই বা কাহাকে বলে, এ-সকল তত্ত্ব কস্মিনকালে বুঝি নাই, কিন্তু বুঝিবার আশা ছিল, আজ সেটুকুও জলাঞ্জলি দিয়া গেলাম । ( ) পশমের গুটিতে জটা পাকাইয়া গেলে যেমন নতমুখে সতর্ক অঙ্গুলিতে ধীরে ধীরে খুলিতে হয়, স্রোতস্বিনী চুপ করিয়া বসিয়া যেন তেমনি ভাবে মনে মনে কথাগুলিকে বহু যত্নে ছাড়াইতে লাগিল । দীপ্তিও মৌনভাবে ছিল ; সমীর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল- কী ভাবিতেছ ? দীপ্তি কহিল— বাঙালির মেয়েদের প্রতিভাবলে বাঙালির ছেলেদের মতো এমন অপরূপ সৃষ্টি কী করিয়া হইল। তাই ভাবিতেছি । আমি কহিলাম— মাটির গুণে সকল সময়ে শিব গড়িতে কৃতকার্য হওয়া যায় না। Ko S \Odo o