পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলা শব্দতত্ত্ব 8ᏬᏳ: বাড়ছে, অবশেষে— থাক, যা অনিবাৰ্য তা তো ঘটবেই, সকল দেশেই ঘটেছে, আগেভাগে এই হচ্ছে সময় যখন উচ্চারণের সঙ্গে মিল করে প্রাকৃত বাংলার বানান অপেক্ষাকৃত নিরাপদে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। আমাদের দেশের পূর্বতন আদর্শ খুব বিশুদ্ধ। বানানের এমন খাঁটি নিয়ম পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় আছে বলে জানি নে। সংস্কৃত ভাষা খুব সূক্ষ্ম বিচার করে উচ্চারণের প্রতি বানানের সদব্যবহার রক্ষা করেছেন। একেই বলা যায় honesty, যথার্থ সাধুতা। বাংলা সাধুভাষাকে honest, ভাষা বলা চলে না। মাতৃভাষাকে সে প্রবঞ্চনা করেছে। । প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যখন লিপিবদ্ধ হয়েছে তখন সে যে ছদ্মবেশে সংস্কৃত ভাষা, পণ্ডিতেরা এমন অভিমান রাখেন নি ; তাদের যথার্থ পাণ্ডিত্য প্রমাণ হয়েছে বানানের যাথার্থ্যে। সেই সনাতন সদৃষ্টান্ত গ্রহণ করবার উপযুক্ত সময় এসেছে। এখনো প্রাকৃত বাংলায় বানানের পাকা দলিল তৈরি হয় নি। এই সময়ে যদি উচ্চারণের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান রক্ষণ করে বানানের ব্যবস্থা হতে পারত তা হলেও কোনো পক্ষ থেকেই নালিশ-ফরিয়াদের যে কোনো আশঙ্কা থাকত না তা বলি নে, কিন্তু তার ধাক্কা হত। অনেক কম। ... t. r চিঠিপত্রে প্রাকৃত বাংলার ব্যবহার কিছুকাল পূর্বেও ছিল না, কিন্তু আমি যতটা প্রমাণ পেয়েছি তাতে বলতে পারি যে আজকাল এই ভাষা ব্যবহারের ব্যতিক্ৰম প্রায় নেই বললেই হয়। মেয়েদের চিঠি যা পেয়ে থাকি তাতে দেখতে পাই যে, উচ্চারণ রক্ষা করে বানান করাকে অপরাধের কোঠায় গণ্য করা হয়েছে, সে সম্বন্ধে তাদের হাঁশি নেই। আমি সাধারণ মেয়েদের কথাই বলছি, বাংলায় যারা এম. এ. পরীক্ষাথিনী তাদের চিঠি আমি খুব বেশি পাই নি। একটি মেয়ের চিঠিতে যখন কোলকাতা বানান দেখলুম। তখন মনে ভারি আনন্দ হল। এই রকম মেয়েদের কাউকে বানান সংস্কার সমিতিকে রাখা উচিত ছিল। কেননা প্রাকৃত বাংলা বানান বিচারে পুরুষদেরই প্রাধান্য এ কথা আমি স্বীকার করি নে। এ পর্যন্ত অলিখিত প্রাকৃত বাংলা ভাষায় রস জুগিয়ে এসেছে মেয়েরাই, ছেলেবেলায় যখন রূপকথা শুনেছি তখন তার প্রমাণ পেয়েছি প্রতি সন্ধ্যাবেলায়। ব্ৰতকথার বাংলা ভাষার প্রতি লক্ষ করলেও আমার কথা স্পষ্ট হবে। এটা জানা যাবে প্রাকৃত বাংলা যেটুকু সাহিত্যরূপ নিয়েছে সে অনেকটাই মেয়েদের মুখে। অবশেষে সত্যের অনুরোধে ময়মনসিংহগীতিকা উপলক্ষে পুরুষের জয় ঘোষণা করতে হবে। এমন অকৃত্রিম ভােবরসে ভরা কাব্য বাংলা ভাষায় বিরল। " : به سد . যে প্রাকৃত বাংলা ভাষা সম্প্রতি সাহিত্যে হরিজন-বৰ্গ থেকে উপরের পঙক্তিতে উঠেছে, তার উচ্চারণ ওকার-বহুল এ কথা মানতে হবে। অনেক মেয়েদের চিঠিতে দেখেছি তাদের ওকারভীতি একেবারেই নেই। তারা মুখে বলেন ‘হােলো, লেখাতেও লেখেন তাই। কেরচি, কোরবো, লিখতে তাদের কলম কঁপে না। ওকারের স্থলে অর্ধকুণ্ডলী ইলেকচিহ্ন ব্যবহার করে তঁরা ঐ নিরপরাধ স্বরবর্ণটার চেহারা চাপা দিতে চান না। বাংলা প্রাকৃতের বিশেষত্ব ঘোষণার প্রধান নকিব হল ঐ ওকার, ইলেকচিহ্নে বা অচিহ্নে ওর মুখ চাপা দেবার ষড়যন্ত্র আমার কাছে সংগত বোধ হয় না। বাঙালির ওকার-ভীতির একটা প্রমাণ পাই ভৌগলিক ও পৌরহিত্য শব্দ ব্যবহারে। সেদিন নতুন বানান-বিধি অনুসারে লিখিত কোনো বইয়ে যখন ‘কাল’ শব্দ চােখে পড়ল তখন অতি স্বল্প একটু সময়ের জন্য আমার খটকা লাগল। পরীক্ষণেই বুঝতে পারলুম লেখক বলতে চান উচ্চারণের ওকার প্রাকৃত বাংলার একটি মূল তত্ত্বের সঙ্গে জড়িত। তত্ত্বটি এই যে দুই অক্ষরবিশিষ্ট