পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8b-8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পাড়ির ছায়ায় শচীশ বসিয়া। সামনের জলটি একেবারে নীলে নীল, ধীরে ধারে চঞ্চল কাদাখোচা লেজ নাচাইয়া সাদা-কালো ডানার ঝলক দিতেছে। কিছু দূরে চখ-চীর দল ভারী গোলমাল করিতে করিতে কিছুতেই পিঠের পালক পুরাপুরি মনের মতো সাফ করিয়া উঠিতে পারিতেছে না। দামিনী পাড়ির উপর দাড়াইতেই তারা ডাকিতে ডাকিতে ডানা মেলিয়া উড়িয়া চলিয়া গেল । দামিনীকে দেখিয়া শচীশ বলিয়া উঠিল, এখানে কেন ? দামিনী বলিল, খাবার আনিয়াছি। শচীশ বলিল, খাইব না । দামিনী বলিল, অনেক বেলা হইয়া গেছে। শচীশ কেবল বলিল, না। দামিনী বলিল, আমি নাহয় একটু বসি তুমি আর-একটু পরে— শচীশ বলিল উঠিল, আহা কেন আমাকে তুমি— হঠাৎ দামিনীর মুখ দেখিয়া সে থামিয়া গেল। দামিনী আর কিছু বলিল না, থালা হাতে করিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। চারি দিকে শূন্ত বালি রাত্রিবেলাকার বাঘের চোখের মতো ঝকঝক করিতে লাগিল । দামিনীর চোখে আগুন যত সহজে জলে, জল তত সহজে পড়ে না । কিন্তু সেদিন যখন তাকে দেখিলাম, দেখি সে মাটিতে পা ছড়াইয়া বসিয়া ; চোখ দিয়া জল পড়িতেছে । আমাকে দেখিয়া তার কান্না যেন বঁাধ ভাঙিয়া ছুটিয়া পড়িল । আমার বুকের ভিতরটা কেমন করিতে লাগিল। আমি এক পাশে বসিলাম । একটু সে সুস্থ হইলে আমি তাকে বলিলাম, শচীশের শরীরের জন্য তুমি এত ভাব কেন ? দামিনী বলিল, আর কিসের জন্য আমি ভাবিতে পারি বলে। আর-সব ভাবনা তো উনি আপনিই ভাবিতেছেন। আমি কি তার কিছু বুঝি না আমি তার কিছু করিতে পারি? ' আমি বলিলাম, দেখে, মানুষের মন যখন অত্যন্ত জোরে কিছু একটাতে গিয়া ঠেকে তখন আপনিই তার শরীরের সমস্ত প্রয়োজন কমিয়া যায়। সেইজন্যই বড়ো দুঃখে কিম্বা বড়ো আনন্দে মামুষের ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে না । এখন শচীশের যে রকম মনের অবস্থা তাতে ওর শরীরের দিকে যদি মন না দাও ওর ক্ষতি হইবে না । দামিনী বলিল, আমি যে স্ত্রীজাত— ওই শরীরটাকেই তো দেহ দিয়া প্রাণ দিয়া গড়িয়া তোলা - আমাদের স্বধৰ্ম । ও যে একেবারে মেয়েদের নিজের কীর্তি।