পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আলাপচারিতায় বলেন, না বাপু, রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা এল বা কারা গেল, তাতে আমাদের কী, আমরা তো গাইব, লিখব, নাটক করব; সাংস্কৃতিক দায়িত্ব আন্তরিকভাবে যদি পালন করি, রাজনীতির মারপ্যাচ নিয়ে মাথা ঘামাব কেন? কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের দখলে গেছে, তাদের কাছাকাছি থাকলে আমাদের সাংস্কৃতিক কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে যদি সুবিধা হয়, তাহলে ক্ষতি কী? আমরা তো কৌশল হিসেবে সমঝোতাকে মান্যতা দিচ্ছি। সাময়িক ঝড় যদি উঠে থাকে সমাজে, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে না-হয় আত্মরক্ষাই করলাম। অন্তত ঝড়ের মুখে কুটোর মতো ভেসে তো যাইনি।

 এইসব গাইয়ে-নাচিয়ে-লিখিয়েদের সাংস্কৃতিক কাজ-কর্মে আন্তরিকতায় কিন্তু কোনও খাদ নেই। অথচ এঁরা মারাত্মক ভ্রান্তির শিকার। এঁরা আসলে ভাবাদর্শের অনস্বীকার্য অস্তিত্বের গুরুত্ব গভীরভাবে অনুধাবন করেননি। আবার এইসব আন্তরিক অথচ বিভ্রান্ত সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে সহাবস্থান করতে গিয়ে কোনও কোনও সংস্কৃতি-সেনানী নিজের অগোচরেই আত্মিক অবসাদের চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে আরম্ভ করেন। ভাবাদর্শের উত্তাপও তাদের আত্মহননের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। তখন মধ্যাহ্নে সূর্যাস্তের উপক্রম হয়। কেন এমন ঘটে? ঘটে এইজন্যে যে প্রাগুক্ত দু-ধরনের কূটাভাস শেষোক্তদের বিশ্বাসের দৃঢ় ভিত্তিকেও একটু একটু করে শিথিল করে দেয়। যাদের সাহচর্যে সংস্কৃতির যুদ্ধ শানিততর হওয়ার কথা ছিল, তাদের পিছিয়ে পড়া কিংবা সাফল্যের হাতছানিতে মুগ্ধ হওয়া অনুভব করতে করতে এঁরা মানবিক উত্তরণ সম্পর্কে অবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। অথচ নিজেদের কাছে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার লক্ষ্যভ্রষ্টতা স্বীকারও করতে পারেন না। এই অন্ধবিন্দুমূলত সময়েরই সংকট, এটা অনুভবে জেনেও ভাবাদর্শের জোর ও প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েন। আর, তেমন মুহূর্তে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন যাতে বহুদিনকার সাংস্কৃতিক উদ্যম এবং সেই উদ্যমে তাদেরই গৌরবজনক ভূমিকা নিরাকৃত হয়ে যায়। এ আসলে ব্যক্তিবাদী ঝোকের এমন একটি ধরন যা সাধারণত বিশ্লেষণের বিষয় হয় না।

 একুশ শতক যে নির্মানবায়ন, নিশ্চিহ্নায়ন ও ভাবাদর্শ-রিক্ততার অন্ধকূপ হয়ে উঠবে—তার যথেষ্ট ইঙ্গিত ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। অতএব সংস্কৃতি কী ও কেন—অনেক পুরনো এই প্রশ্নের সময়োপযোগী মীমাংসা চাই। এ চেষ্টা তাত্ত্বিকেরা করতেই পারেন; কিন্তু প্রয়োগের মধ্য দিয়ে যা অনুভব করছি, তা-ই মাননীয়। কেননা সংস্কৃতি মানে উপস্থাপনার কৃতি। অতএব সক্রিয় হতে গিয়ে যদি মঞ্চশোভন হওয়ার নেশায় মদির হই এবং প্রভাব ছড়িয়ে দেওয়ার তাড়নায় পণ্যায়নের যুক্তিশৃঙ্খলার সঙ্গে আপস করি—তাহলে সর্ষের ভেতরে ভূত ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কাই সত্য হয়ে উঠবে। এইজন্যে আদি-প্রশ্নটির উত্তর একই সঙ্গে সরল ও জটিল। যদি ভাবি, সংস্কৃতি মানে নাচ-গান-ছবি-কবিতা-নাটক কিংবা সমস্যাদীর্ণ পৃথিবী থেকে ছুটি নিয়ে বিনোদনের মুহূর্ত-যাপন: তাহলে একে বলব সরল উত্তর। একে মিথ্যা বলা যাবে না হয়তো কিন্তু

১১৭