পেয়েছিল। বুঝেছিল, সংস্কৃতি নিছক কবিতা-নাটক-গান-গল্প-ছবি কিংবা আত্ম-সন্তুষ্টির আয়োজন নয়, সমস্ত কুশ্রীতা ও আত্মিক দৈন্যের আস্ফালনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের তীক্ষ্ণ অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্যবহার করতে গিয়েই বেঞ্জামিন মেলোয়েজ, সফদার হাসমি, ব্রজলাল অধিকারীর মতো সংস্কৃতি-যোদ্ধারা ইতিহাস হয়ে যান। এই অস্ত্র সম্বল করেই পল রোবসন, পিট সিগারেরা দেশ-জাতি-ভাষা-ধর্ম-বর্ণের সীমানা পেরিয়ে যান অনায়াসে।
৩
আধুনিকতা যখন অবক্ষয়বাদের চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছিল, ভাবাদর্শকে নস্যাৎ করার জন্যে কখনও ঠাট্টা-মস্করা আর কখনও ধূর্ত অপতত্ত্ব ব্যবহার করার প্রবণতা ছিল। সংস্কৃতিকর্মীদের দায় শুধু নাচ-গান-নাটক আয়োজনের উপযোগী সংগঠন করেই ফুরিয়ে যায়নি; প্রগাঢ় আবেগে বিশ্বাসের আলো জ্বালিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কর্তব্য শেষ হয়নি। তাদের সতর্ক থাকতে হয়েছিল অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের প্রকাশ্য ও গোপন সন্ত্রাস সম্পর্কেও। জীবন-যাপন ও সমাজ-সংস্থানের প্রতিটি স্তরে সর্বাত্মক 1 সংগ্রাম অব্যাহত না রাখলে যে-কোনও অসতর্ক মুহূর্তে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আত্মরতির মোহিনী মায়া ছড়িয়ে আধিপত্যবাদ কত প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন সংস্কৃতি-সেনানীকে পথভ্রষ্ট করেছে, ইতিহাস তার সাক্ষী। আবার গণনাট্য আন্দোলনের উপলবন্ধুর পথ চলার ইতিবৃত্ত যদি লক্ষ করি, দেখব, ভোগবাদ ও পণ্যায়নের অজস্র চোরা-ফাদ এড়িয়ে গিয়েই জনতার মুখরিত সখ্যকে তা ধ্রুববিন্দু করে নিতে পেরেছে। গত ছয় দশকে ভাবাদর্শকে নাকচ করার কম আয়োজন ছিল না। তবু পথে নেমে পথ চিনে নেওয়ার প্রক্রিয়া থেমে যায়নি। বিশেষত গত এক দশকে আধুনিকোত্তরবাদী পর্যায়ের বৌদ্ধিক সন্ত্রাস ও প্রতিভাবাদর্শের আক্রমণ মোকাবিলা করতে গিয়ে সংস্কৃতির যুদ্ধ পুরোপুরি নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে। নিঃসন্দেহে সময় এখন আরও জটিল আবর্তময়। তাই সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের নিবিড় গ্রন্থনার তাৎপর্য বোঝার জন্যে নতুন নতুন প্রায়োগিক কৃৎকৌশল আবিষ্কার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। যুদ্ধটা যখন নতুন, যুদ্ধের পুরোনো আয়ুধও অচল। ইদানীং সংশয় ও আপস যেভাবে আত্মিক আঁধি তৈরি করছে, তাতে মনে হয়, পীড়া সংক্রমণের কারণগুলিকে এবার নতুন চোখে দেখা শুরু করতে হবে। আর, সেইসঙ্গে পীড়া উপশমের জন্যে এবং সংস্কৃতিচর্যার মধ্যে ভাবাদর্শের নির্যাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে পুরোপুরি নতুন ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।
বয়ানে কি ঔচিত্যের প্রসঙ্গ বেশি চলে এল! আসলে ঔচিত্যবোধ মানেই প্রত্যাশার নতুন দিগন্ত আর উদ্ভাসনের নতুন পরম্পরা। সংস্কৃতি-কর্মীরও তো স্পষ্ট একটা লক্ষ্য থাকে। সেই লক্ষ্য সম্পর্কিত ধারণাকে মাঝে-মাঝে পুনর্নবায়িত করে নিতে হয়। নইলে নিজেদের অগোচরে আত্মিক অবসাদ তৈরি হবে; ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সত্তার মধ্যে আকস্মিকভাবে দেখা দেবে অনন্বয়ের কুয়াশা। অতএব পুরনো বোতলে নতুন পানীয় নয়, নতুন আধারে নতুন আধেয় পরিবেশন করার জন্যে সংস্কৃতিকর্মীদের সব সময়