পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পণ্যায়ন প্রক্রিয়ায় মিশিয়ে দিতে পারছি-বাইশ শতকেও যাব সবাই ডঙ্কা বাজিয়ে। যে-মনোভঙ্গি থেকে প্রতিবাদ দূরে থাক, জিজ্ঞাসাই দেখা দেয় না—তাতে শোষকবর্গের পোয়াবারো। তাদেরই রঙে রঞ্জিত ভাবাদর্শ দিয়ে জগৎ শাসিত ও প্রান্তিকায়িত হচ্ছে। অথচ এমনই নিদালির ঘোর আস্তিক্যবাদের নামে ছড়িয়ে পড়েছে যে নিজেদের তীব্রতম লাঞ্ছনাতেও নিম্নবর্গীয়দের ‘পিপুফিশু’ নীতি অবিচল থাকছে।

 এই অবস্থায় একটি প্রশ্ন এখন অনিবার্য: সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে-চলতে আস্তিক্যবাদ যেহেতু সমস্ত ধরনের সুবিধাবাদের আশ্রয়ভূমি হিসেবে খুবই নির্ভরযোগ্য এবং এর স্থিতিস্থাপকতাকে অদ্ভুত দক্ষতায় কাজে লাগিয়ে চলেছে। প্রতিটি সময়-পর্বের শোষকবর্গ—কীভাবে এর মোকাবিলা করা সম্ভব? আদৌ সম্ভব কি একাজ? যখন শিক্ষিত-অশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী-পণ্যজীবী ধনী-দ্ররিদ্র ঐতিহ্যপন্থীবর্তমানপন্থী-নির্বিশেষে আস্তিক্যবাদের মোড়ক মেনে নিয়েছে, এদের সত্যভ্রমের আস্ফালন ঘোচাবে কে? প্রবাদের সেই বালকটি কোথাও কি আছে যে উলঙ্গ রাজার দিকে আঙুল তুলে বলতে পারে, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়? এই পুঞ্জীভূত মিথ্যার জঞ্জাল সরিয়ে বিমানবায়নের চক্রব্যুহ থেকে মানুষকে যে উদ্ধার করবে, সেই হেরাক্লিস কোথায়? কোথায় সেই প্রমিথিউস যে আগুন নিয়ে এসে নিচ্ছিদ্র সেই অন্ধকারের বলয় ভেদ করবে? একাজ করতে পারে কেবল তারাই যারা রাষ্ট্রশক্তির অনুগ্রহপুষ্ট নয়, পৌর সমাজের মধ্যে যাদের অবস্থান পরিত্যক্ত বহিরাগতের মতো, অপপ্রচারের আঁধিতে আচ্ছন্ন হয়েও যারা সত্যের অন্তর্দীপ্তিতে উজ্জ্বল। সবচেয়ে বড়ো কথা, অপরিসীম আত্মশক্তিতে বলীয়ান বলে এধরনের মানুষ নিজেকে ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না। কখনো কোনো শাস্ত্রবাক্যের দোহাই দেয় না, মোহমুক্ত যুক্তিবিদ্যা ছাড়া অন্য কিছুতে নির্ভরতা দেখায় না। প্রত্যক্ষ জগৎকে বেশি গুরুত্ব দেয় বলে যারা দৃশ্যমান জীবনেই বেঁচে থাকার সমস্ত স্বাদ পেতে চায়, তাদের আস্তিক্যবোধের তুলনা নেই কোননা। অথচ যুগ যুগ ধরে তারা বহন করে চলেছে নাস্তিকের নেতিবাচক অভিধা। সন্দেহ নেই যে, আমাদের সমাজে এই অভিধা আসলে অপবাদ ও তাচ্ছিল্যের অন্য নাম। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জগৎ ও জীবনকে দেখে তথাকথিত নাস্তিকেরা। এদেশে যখন চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে কানে হাত-না দিয়ে চিলের পেছনে ছুটে যাওয়াটা নিয়ম, নাস্তিকেরা সেখানে বলে যুক্তির প্রামাণিকতার কথা, বলে শাস্ত্রবাক্যের অকার্যকারিতার কথা।‘বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ, তর্কে বহুদূর’ বলে তার্কিকদের মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালার ব্যবস্থা তথাকথিত আস্তিকেরাই করে এসেছে চিরকাল। যুক্তি যাদের পক্ষে নেই, ওরা তো যুক্তিবাদকে প্রত্যাখ্যান করবেই। প্রচারমাধ্যম তাদের হাতে, অতএব অলৌকিক গল্পকথা দিয়ে শাস্ত্রবাক্যের অচলায়তনকে দুর্ভেদ্য করতে ওদের অসুবিধে হয়নি। বিশ্বাসের কত লাভ আর অবিশ্বাসের কত লোমহর্ষক ভয়ঙ্কর পরিণতি, সেজন্যে পরলোকে স্বর্গনরকের বৃত্তান্ত আর ইহলোকে ভোগসুখ ও

১৩১