পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মননে নিত্যনূতন পরিসর আবিষ্কারের হাতছানি। লোকায়ত সমাজ যুগ যুগ ধরে কোনদিকে ঝুঁকে ছিল—তা বলার অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়। কিন্তু তাই বলে আধিপত্যবাদী বর্গ কি হাল ছেড়ে দিতে পারে? ভয় দেখিয়ে, শাস্তি দিয়ে, ঠাট্টা করে নাস্তিকদের ওরা জব্দ করতে চেয়েছে। দর্শনের এই রাজনীতি তো কেবল তাত্ত্বিক বিতর্কে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; সাহিত্যেও স্বভাবত তার ছায়া পড়েছে। লোকায়ত সমাজের প্রতিবাদী মননকে বিদ্রুপে বিদ্ধ করে বাল্মীকিও যুক্তিবিদ্যাকে নিন্দা করেছেন কুতর্ক বলে, দুবুদ্ধির প্রমাণ বলে। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে রাম ভরতকে যেসব লোকায়ত দার্শনিকদের সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন, ওরা মূলত তার্কিক। এই তার্কিকতার মৌল প্রেরণা যে নাস্তিক্যবাদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, তাতে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ, তার্কিকেরা কখনো প্রতাপের ভাবাদর্শকে যাচাই করতে ভোলে না; ঈশ্বর-পারত্রিকতা ঐহিক ধর্মসংস্কার-জাতিভেদ-উচুনিচুর বিভাজন (কী জীবনে কী মননে): কোনো কিছুই তাদের সন্ত্রস্ত করে না। অতএব, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কৃষ্টিনায়ক হিসেবে রামকে বলতেই হল:

‘অনর্থকুশলা হ্যেতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ
ধর্মশাস্ত্রে মুখ্যে বিদ্যমাননযু দুর্বধাঃ।
বুদ্ধি আত্মীক্ষিকীং প্রাপ্য নিরর্থকং প্রবদন্তি তে!!’

(২: ১০০: ৩৮-৩৯)

এই উচ্চারণ তো প্রজ্ঞাভিমানী উচ্চবর্গীয়দের, যারা তখনও মনে করত এবং এখনো মনে করে, সত্য হল তাই যাকে তারা সত্য মনে করে। তাদের মেধায় এবং তাদের প্রয়োজনে তৈরি শাস্ত্র সব শেষ কথা বলে দিয়েছে। এর বাইরে সমাজের নিচুতলার অপাঙক্তেয় জনদের জন্যে আর কোন সত্য থাকা সম্ভব! সাম্প্রতিক কবি জয় গোস্বামী যেমন তির্যক উচ্চারণে জানিয়েছেন: ‘আমরা যা করি ব্রহ্ম তা-ই আজ ব্রহ্ম তা-ই’—তেমনি ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বলতে চেয়েছেন, আধিপত্যবাদের দর্শনকে যা পোষকতা করে তা-ই সৎ বুদ্ধি এবং যেসব মূঢ়জন ওই দর্শনকে প্রত্যাহ্বান জানানোর দুঃসাহস দেখায়, তাদের কাজ দুবুদ্ধি প্রণোদিত ও নিরর্থক।

 রাষ্ট্রশাসকের এই ঔদ্ধত্য অস্বাভাবিক নয় কিছু; আসলে, এধরনের মনোভঙ্গি পোষণ করা তাদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। কারণ, তাদের শাসনব্যবস্থাই তো টিকে থাকে আস্তিক্যবাদের প্রচারক শাস্ত্রবিধির উপর। শাস্ত্রবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তিবিদ্যার সম্পর্ক সাপে-নেউলে; অতএব নাস্তিকদের সমূলে উচ্ছেদ করার জন্যে শোষকেরা লাগাতার চেষ্টা করে যাবেই। যেমন মনুসংহিতার মনু (৪/৩০) দুঃসাহসী প্রতিবাদীদের কষে গালাগাল করেছেন; তাদের বুঝতে দেরি হয়নি, যুক্তিবিদ্যা ও নাস্তিকতা গঙ্গাযমুনার মতো অনন্যান্য-সম্পৃক্ত। অতএব যারা তার্কিক বা হেতুশাস্ত্র অনুসরণকারী, তাদের মনু বলেছেন পাষণ্ড, নিষিদ্ধবৃত্তি অবলম্বনকারী, ভণ্ড, শঠ, দাম্ভিক। কিছুতেই তাদের সঙ্গে

১৩৪