পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নইলে ধারাবাহিক ভাবে অবক্ষয়ের বিষ-জীবাণু সংক্রামিত করে তরুণ লেখক-প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করতে থাকবে প্রতিষ্ঠান। লিটল ম্যাগাজিনের পালের হাওয়া সহজে কেড়ে নেওয়া যায় না নিশ্চয়। কিন্তু এও অনস্বীকার্য যে, বারবার চিলের মতো ছো ঁদিয়ে প্রতিষ্ঠান যদি শিকার তুলে নিতে থাকে—ছোট পত্রিকার অস্তিত্বগত তাৎপর্য অনেকখানি অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। বিশেষত লড়াই যখন সম্মিলিত তারুণ্যের সঙ্গে সর্বগ্রাসী দাম্ভিক মিথ্যার, এই অপক্রিয়ার সম্ভাব্য পরিণতি জনিত সংকটকে হাল্কাভাবে দেখা চলে না। এ বিষয়ে বিশেষ অবহিত সুবিমল লিখেছেন: ‘প্রতিষ্ঠানের প্রভাব এমন গভীর ও নেপথ্যচারী যে খুব কম সাহিত্যিকের পক্ষেই সম্ভব তার গ্রাস থেকে রেহাই পাওয়া। প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিশীল, প্রতিভাসম্পন্ন উঠতি তরুণ কবি-সাহিত্যিকের সামনে এক আপাত-দুর্ভেদ্য, অথচ বহু বর্ণ-সমন্বিত মায়াবী রহস্যের দরজা খুলে দেয়, ঝালরি পর্দা দোলায়, তখন খ্যাতির মোহ, অর্থের লোভ, প্রতিষ্ঠার নিশ্চিতি থেকে নিজেকে নিরাপদে সরিয়ে রাখা সত্যিই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ওরা মুক্ত চিন্তার, নিশ্চিতির কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, উদার নীতির কথা শোনায়, চাই কি গভীর বোধজাত নান্দনিকতার কথা উচ্চারণ করে, প্রতিষ্ঠানে প্রবিষ্ট হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, কিন্তু একবার স্বর্ণশৃঙ্খলিত ফটক পেরুলেই চিরবন্দী।” (১৯৯৫:৭৬) খুব সত্যি কথা। এত দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনে আছে যে বন্দিত্বের আগে ও পরে কীভাবে একই মানুষ দুই মানুষে পরিণত হয়—এটা খোজার জন্যে কোনো তাত্ত্বিক বয়ানের প্রয়োজন পড়ে। ছোট পত্রিকার ধ্বজদণ্ড যাঁরা বহন করেন, তাদের আসলে শুরুতেই জীবন সম্পর্কে একটি মৌলিক ঘোষণা করে নিতে হয়। অন্য কারও কাছে নয়, নিজেরই কাছে। একটাই। তো জীবন আমাদের, একে স্বাধীন রাখব নাকি সম্ভোগের নেশায় বন্ধক রাখব প্রতাপের কাছে? কী করব এই জীবন নিয়ে: বাঙালির কাছে এই প্রশ্ন নতুন নয়। লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলনে যাঁরা শরিক, তাঁরা এই পুরনো প্রশ্ন তবু পুনরুত্থাপন করছেন অনেক বেশি মরিয়া হয়ে। বলা ভালো, কার্যত জীবন-মরণ প্রশ্ন হিসেবে।

 কিন্তু ‘করছেন’ ক্রিয়াপদটি কি যথার্থ প্রয়োেগ হল? সত্যিই করছেন কি তারা! নাকি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে প্রসারিত সামাজিক বিষয়বস্তুকে দেখার মতো দ্রষ্টা-চক্ষু যাদের অধিগত, সংখ্যাগত বিচারে তারা আসলে হাজারে এক? তাহলে, ছোট পত্রিকা কেন করছেন সরকার আশরাফ বা সমীরণ মজুমদারের মতো সম্পাদক-সংগঠক? তারাও কি মনের মতো লেখা ছাপাতে পারেন সব সময়! নাকি স্বপ্নের লেখা ছাপানোর স্বপ্ন দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাচ্ছে অনেক দিনরাত্রি! প্রচলিত পদ্ধতিতে যা কুলোয়, সেই সময়-বাহিত অস্তবস্তু কটি প্রতিবেদনে থাকে? বিপ্লবী বক্তব্যের জন্যে বিপ্লবী উপস্থাপনার অনিবার্যতা কজন জানেন, বোঝেন এবং প্রয়োগ করছেন! এই প্রশ্নমালার জবাবে যে অনিশ্চিত উত্তর আসবে বলে অনুন করছি, তাতেই কি ছোট পত্রিকার আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার কারণ নিহিত নেই? এই নিবন্ধের শুরুতে আত্মবিনির্মাণের কথা যে লিখেছি, সেখানেই কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের সবচেয়ে বড়ো জোর। কেননা নিজেকে অনবরত ভাঙতে পারে না যে, প্রতিটি পরবর্তী মুহূর্তে সে তো আত্মপ্রতিষ্ঠানে

১৪৭