পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তেমনি নারীচেতনাবাদী দর্শন ও নন্দন সম্পর্কে যিনি জিজ্ঞাসু নন, তার পক্ষে সাহিত্যের সমস্ত প্রধান স্থাপত্যের গভীরে বিরাজমান ঋদ্ধ অন্তঃস্বরগুলি অস্তিত্বশূন্য হয়েই থাকবে। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রবাদ-প্রতিম নাট্যসংলাপের প্রতিধ্বনি করে বলা যায়, অন্ধের কিবা দিন কিবা রাত্রি! কিংবা পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বাস ও সংস্কারে যেসব লেখিকা আনখশির প্রোথিত, তাঁদের রচনা কেন তাৎপর্যহীন, এর উত্তর পাওয়া সম্ভব শুধু নারীচেতনাবাদের দর্পণে। নারীর আত্মকথামূলক রচনার সাম্প্রতিক আললাচনাগুলি থেকে বুঝতে পারি, প্রাসঙ্গিক তত্ত্বভাবনায় নিষ্ণাত হওয়ার ফলেই এতদিনকার অন্ধকার পরিসর ক্রমাগত আলোকিত হয়ে উঠছে। আশালতা সিংহ, জ্যোতির্ময়ী দেবীদের রচনা নবার্জিত শ্রদ্ধা ও মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু হয়েছ। আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, সেলিনা হোসেন, সুচিত্রা ভটাচার্যদের চেতনাবিশ্ব কি যথার্থ তত্ত্বভাবনা ছাড়া বিশ্লেষণ করা আদৌ সম্ভব?

 আখ্যানতত্ত্ব ও প্রতিবেদনতত্ত্ব কীভাবে সাম্প্রতিক তত্ত্ববিশ্বের পুরোধা চিন্তাবিদদের অবদানে অভাবনীয় সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, সে-সম্পর্কে উদাসীন থাকার নিজেদের মনন-জিজ্ঞাসাকে পঙ্গু করে দেওয়া। বিশ্বায়ন কি কেবল দুনিয়াজোড়া বাজারের হট্টমেলায় ক্রেতা-বিক্রেতা হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্যে? রবীন্দ্রনাথ যেদিন ‘যত্র বিশ্ব ভবতি একনীড়ম’-এর ভাবকল্প দিয়েছিলেন আমাদের, সেদিনই তো সমস্ত নঞর্থক প্রবণতা মুছে দিয়ে সদর্থক বিশ্বায়নের বার্তা প্রচারিত হয়েছিল। মানববিশ্বে যা কিছু জ্ঞেয় ও আগ্রহ-উদ্দীপক, তাতে যে-কোনো মানুষের অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। অতএব আখ্যান আর কাহিনি মনোলোভা মায়ামৃগ মাত্র নয় কিংবা প্রতিবেদনও নয় যে-কোনো সন্দর্ভ। মানুষের চিন্তাবিশ্ব থেকে উৎসারিত অজস্র বিচ্ছুরণে আখ্যান ও প্রতিবেদন আজ অনেকান্তিক ও অনেকার্থদ্যোতক। তত্ত্ব-নিরপেক্ষতা আসলে অসাড় চিত্তবৃত্তির লক্ষণ। আজ সর্বব্যাপ্ত রাজনৈতিক অর্থনীতির পেষণে কীভাবে অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে পুরনো চিহ্নায়ক মুছে গিয়ে চিহ্নায়নের নতুন প্রকরণ জেগে উঠছে—এ বিষয়ে যিনি অবহিত নন, তার পক্ষে আজকের আখ্যান ও প্রতিবেদনের অভিনবত্ব উপলব্ধি অসম্ভব।

 দেবেশ রায়ের ‘একটি ইচ্ছামৃত্যুর প্রতিবেদন’, নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’, স্বপন সেনের ‘মুখোশযোদ্ধা’ রবিশঙ্কর বলের ‘পোখরান ৯৮' ইত্যাদি কেন ঔপন্যাসিকতার নব্য গ্রন্থনার নিদর্শন, তা শুধুমাত্র বিবর্তনশীল আখ্যানতত্ত্বের নিরিখে বুঝে নেওয়া সম্ভব। সত্তর পরবর্তী ভারতবর্ষের দ্রুত বিবর্তনশীল রাজনৈতিক অবচেতনা, বহুরৈখিক বাস্তবতা, চেতনার অনেকান্তিকতা কীভাবে লেখক-কথক স্বরের নতুন অন্তর্বয়ন এবং মুক্ত পাঠকৃতির বিশ্বাসে প্রতিফলিত হচ্ছে—তা যখন বুঝে নিই, অভিজিৎ সেনের ‘রহুচণ্ডালের হাড়’ ও ‘দেবাংশী’, ভগীরথ মিশ্রের ‘চারণভূমি’ ও ‘মৃগয়া’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষবিপক্ষ’ ও ‘জলতিমির’, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্বজনভূমি’ ও ‘চরপূর্ণিমা’, আফসার আমেদের ‘বিবির মিথ্যা তালাক ও তালাকের বিবি এবং হলুদ পাখির কিসসা’ ও ‘কালো বোরখার বিবি ও কুসুমের গন্ধ এবং

১৫৯