জ্ঞানাঞ্জন-শলাকার মতো অভ্যাসের জাড্য ও অন্ধকার দূর করে দেয়, তাতে আমাদের বড়ো ভয়। কিন্তু সৌভাগ্যের কথা, বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের বিপুল দৈন্যের মধ্যেও এমন কয়েকজন চিন্তাবিদকে পাওয়া গেছে, যারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রবন্ধ কেবল নির্দিষ্ট বিষয়ের গণ্ডিতে রুদ্ধ রচনা মাত্র নয়। তাদের বয়ানে মিশে থাকে দার্শনিক চিন্তার দ্যুতি, সমাজতত্ত্বের নির্যাস, ইতিহাসের চলিষ্ণুতা।
৪
শঙ্খ ঘোষের প্রবন্ধে আমরা যে-ধরনের পাঠকৃতির মুখোমুখি হই, তা কি কেবল বিষয়-গৌরবে আমাদের আকৃষ্ট করে? নাকি তার প্রতিটি বাক্যে গভীর দার্শনিক বাচনের দ্যুতি বিকীর্ণ হয়? অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রবন্ধে বিপুল মানব-বিশ্বের অনেকান্তিক অভিজ্ঞতা কি একনীড় হয়ে ওঠে না? প্রবন্ধ মানে জিজ্ঞাসার বয়ন; মীমাংসার ছলে আরও জিজ্ঞাসা উসকে দেওয়া। মানবিকী বিদ্যার বিভিন্ন প্রাঙ্গন থেকে কুসুম চয়ন করে একটি মালা গেঁথে নেওয়াই প্রাবন্ধিকের অন্বিষ্ট। বিষয় সাহিত্য হোক বা না হোক, প্রবন্ধকে সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন অর্থাৎ নান্দনিকবোধে ঋদ্ধ হতেই হবে। আর, দার্শনিক উপলব্ধির সূত্রায়িত বিন্যাস ঘটবে তাতে। আমরা যখন প্রবন্ধ পড়ব, চেনা জগতের অচেনা আদল খুঁজে নিতে চাইব। অতি পরিচিত জগৎ ও জীবনের অভ্যস্ত ব্যাখ্যা পেয়ে যারা সন্তুষ্ট, প্রবন্ধ তাদের জন্যে নয়। প্রবন্ধ পড়ে প্রাবন্ধিকের সঙ্গে একমত হতে হবে, তা কিন্তু নয়। তিনি সাহিত্য ও সমাজ কিংবা সাহিত্য ও দর্শন কিংবা সাহিত্য ও ইতিহাসের বহুমাত্রিক যুগলবন্দি উপলব্ধি করবেন: এইটুকুই শুধু প্রত্যাশিত। তার মানে, কোনো প্রবন্ধে যদি কোথাও কোনো তত্ত্ববীজ বয়ানের মধ্যে বিকশিত না হয়, তাহলে তা ‘প্রবন্ধ’ অভিধার যোগ্যই নয়।
কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিকেরা যখন নিজেদের সৃজনী অভিজ্ঞতার নিরিখে সাহিত্যের হওয়া ও হয়ে ওঠা নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন, তাঁদের রচনায় ভিন্ন মাত্রা নিশ্চয় প্রত্যাশিত। কিন্তু তাদের কাছেও আমরা চাইব দৃষ্টির প্রসার ও গভীরতা। সব সময় আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়, একথা অবশ্য বলা যায় না। জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে উত্তম প্রাবন্ধিক ছিলেন। তাঁদের বয়ানে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নান্দনিক ভাবাদর্শ ও সময়-চেতনার অভিব্যক্তি দেখেছি। নিবিড় পুনঃপাঠে তাদের প্রবন্ধ থেকে নানা ধরনের তত্ত্ববীজ আবিষ্কার করা সম্ভব। শঙ্খ-অলোকরঞ্জনের কথা আগেই লিখেছি। এছাড়া দেবেশ রায়, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রবন্ধেও সমান সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই তালিকা দীর্ঘ নয়। কবিতার কথা’, ‘উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে’, ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ দার্শনিক মননে ঋদ্ধ, তা আজও আমরা ভালোভাবে লক্ষ করিনি। আসলে আমাদের সাহিত্যিক পাঠকৃতির ঐতিহ্যে ‘কবি ক্রান্তদশী কিংবা কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভুঃ ইত্যাদি নিছক প্রাজ্ঞোক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বলা ভালো, কথার কথা মাত্র হয়ে থেকেছে। এইসব উচ্চারণের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণের চেষ্টা হয়তো করেছি, কিন্তু এদের অন্তর্নিহিত