পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ্যালসেশিয়ানটি। তারপর চমকে উঠে আসগর। অতিথিদের বিদায় দিয়ে সরোয়ার কবির এই তো ভেতরে গেলো, ১৫ মিনিটের মধ্যে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা আঁচ করতে পারলে এখন বোতল ঠোটে ধরার সাহস আসগরের হয়? মিনিট দশেক আগেও বারান্দায় বসে সে আরগসের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, সরোয়ার কবির ফিরে আসবে জানলে তাই অব্যাহত রাখা যেতো। আসগরের লাকটাই এরকম, সায়েবের ফেবারিট কাজগুলো যখন করে সায়েব তখন লক্ষ্যই করে না। সরোয়ার কবিরের গলা পর্যন্ত এখন ডিম্পলে শিভাজ রিগ্যালে টইটম্বুর, সাহিত্য কি কোষ্ঠকাঠিন্য কি নিজের ব্রিলিয়াণ্ট অ্যাকাদেমিক ক্যারিয়ার নিয়ে কথাবার্তা শুরু করে তো রাতটা বসে বসেই কাবার।

 এই যে বয়ান, কানির্ভালের শ্লেষ-তিক্ত হাসি যেন তার প্রতিটি বাক্যকে ভেতর থেকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে। যে-সমাজে পারাপারহীন অসাম্য অকাট্য বাস্তব, মানুষ সেখানে পশুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সামাজিক পরিসরের ভেতরকার পাশবিকতা আসগর হোসেনকে দাক্ষিণ্যের জন্যে কাঙাল করেনি শুধু, তাকে পোষা কুকুরের চেয়েও নিচু অবস্থানে নিয়ে গেছে। একদিকে সরোয়ার কবিরের মতো অপমানুষদের বিলাসিতার অপব্যয় আকাশ ছুঁইছুঁই, অন্যদিকে আসগরের মতো অস্তেবাসী ব্রাত্য মানুষ মিলিয়ে যায় ছায়াচ্ছন্নতায়। মাঝখানে অ্যালসেশিয়ান আরগস চূড়ান্ত বিদ্রুপের মতো বিরাজমান। প্রকৃতপক্ষে এই গল্পের প্রথম বাক্যে শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের অন্তেবাসী ও তার হাস্যকর অবস্থান শ্লেষতিক্ত চিহ্নায়কে উপস্থাপিত। ঘরে বউ না থাকলেও সোফায় বসার সাহস হয় না আসগরের। ভালো খাদ্য ও পানীয়কে সে কেবল দূর থেকে আড়চোখে দেখতে পারে। আর, নিতান্ত ছিচকে ভিখিরির মতো কার্পেটে বসে খালি সব মদের বোতল থেকে ফোঁটা ফোঁটা তলানি নিজের জিভে ঢালতে পারে। দারিদ্রই চৌর্যবৃত্তি’—এই কথাটি প্রবচনের মর্যাদা পেয়েছে, আমরা জানি। আসলে সম্পদই মানুষের পৃথিবীতে অজস্র ধুপছায়ার অঞ্চল এবং নিরালোক বৃত্ত তৈরি করে। সেই বৃত্তের বিধিবিন্যাস আলাদা। একজন সংবেদনশীল গল্পকার ওই সমান্তরাল পরিসরের প্রতি তর্জনি সংকেত করেন না কেবল, মানিয়ে নেওয়ার ছলে কীভাবে হতমান মানুষ ধাপে ধাপে নামতে নামতে পশুর স্তরে পৌছে যায়—তাও নির্মম নিরাসক্তি দিয়ে প্রকাশ করেন। অ্যালসেশিয়ানের নামকরণ করতে হোমারের মহাকাব্যিক জগৎ থেকে ‘আরগস’ কে বেছে নেয় যারা, তাদের কাছে কুকুরের সম্রম ও আভিজাত্য ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসগর বিলিতি কুকুরের কাছাকাছি মর্যাদায়ও থাকতে পারে না, প্রভুকে খুশি করার প্রয়োজনে কুকুরকেও তোয়াজ করতে হয় তাকে। মানুষের এই অবনমন শ্রেণীবিভক্ত সমাজেই ঘটে। তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তব তো এই যে নিজের অবনমন এবং বাধ্যতামূলক নরকের বলয় সম্পর্কে সেই মানুষটি স্বয়ং চেতনাশূন্য, বোধহীন। মনে পড়ে যায় ওয়ার্সওয়ার্থের প্রবাদপ্রতিম পঙক্তি, ‘What man has made of man'!

 অতএব বারান্দায় বসে আসগর প্রভুর কুকুরের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় একমাত্র এই

১৬৮