পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কল্পনার পরিসরকে চূড়ান্তভাবে মুছে ফেলছে। সূক্ষ্মতা, কল্পনা ও মানবিকতার উপর এমন বীভৎস আক্রমণ আগে কখনো দেখা যায়নি।

 সব মিলিয়ে, এ কোন্ পৃথিবীর ছবি যেখানে প্রতিবাস্তব ও প্রতিসন্দর্ভের মায়া আমাদের এতদিনকার সমস্ত নান্দনিক ও সাংস্কৃতিক উপার্জনকে নিরালম্ব করে দিচ্ছে? আধুনিকতাবাদ মানুষকে যদিও নিঃসঙ্গ করেছিল, তবুও সেই নিঃসঙ্গ মানুষের নিজস্ব নির্জনতা লুপ্ত হয়ে যায় নি। কিন্তু যন্ত্র-প্রযুক্তি দ্বারা উৎপাদিত মাদকগ্রস্ত প্রতিজগতে আধুনিকোত্তরবাদ সেই নিঃসঙ্গতা আর নির্জনতার অবকাশও রাখেনি কোথাও। কর্কশ কোলাহলের স্থূল সন্ত্রাসে অবয়বহীন ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে সব সূক্ষ্মতা, সব স্বপ্ন, সব কল্পনা। একুশ শতক বা তৃতীয় সহস্রাব্দের নামে তৃতীয় বিশ্বের যেসব আত্মবিস্মৃত মানুষজনেরা গন্তব্যহীন স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা টেরও পাচ্ছেন না কীভাবে তাদের শিথিল মুঠো থেকে বালির মতো ঝুরঝুর করে পড়ে যাচ্ছে যাবতীয় সংকল্প ও উদ্যম, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা, সৃষ্টি ও নন্দন। প্রথম দুনিয়ার বহু হাত-ফেরতা সিকি আধুলি নিয়ে কেউ কেউ মশগুল হয়ে পড়ছেন। নিজেদের যথাপ্রাপ্ত পরিসর ও পরম্পরার সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে উপন্যাস-ছছাটগল্প-কবিতার প্রতিবেদন তৈরি করতে চাইছেন। ফলে তাদের রচনা-প্রয়াস হয়ে উঠছে কৃষ্ণবিবরের দৃষ্টান্ত, যা বারবার, এমনকী তারা নিজেরাও পুনরাবৃত্ত করতে পারছেন না।

 তাছাড়া আরো একটি মৌলিক প্রশ্নও উঠে আসছে এখন। আধুনিকতাবাদ লোকসংস্কৃতি ও লোকায়ত জীবনচর্যাকে উপেক্ষা করতে শিখিয়েছিল, ছড়িয়েছিল পরিশীলিত নাগরিকতার মোহ। আধুনিকোত্তরবাদ সেই মোহকে প্রযুক্তি-সন্ত্রাসের সাহায্যে সময়-নিরপেক্ষ, পরিসর-নিরপেক্ষ অধিবাস্তবের গোলকধাঁধায় পাকাপোক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। স্পন্দমান জীবনের কথকতা নয় আর, ঈপ্সিত এখন সেই সর্বাত্মক ভোগবাদ যার প্রভাবে দিন-রাত্রি চেতনা-অবচেতনা-ভূত-ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়। আরো একটি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াও বিষাক্ত ছত্রাকের মতো ছড়িয়ে গেছে। সর্বত্র। গণমাধ্যমের বলয় বিশ্বায়িত হওয়ার ফলে লোকসংস্কৃতির উৎসভূমি খরার দাবদাহে পোড়া জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে দ্রুত।

 আজ যাঁরা সাহসী মুঠোয় ছোট পত্রিকার পতাকা ধরে রাখতে চাইবেন, তাদের লড়াই অনেক বেশি কঠিন। কেননা তারা বাস করছেন জা বদ্রিলার কথিত ‘Hyperreal' জগতে। যেখানে ‘The model comes first and its constitutive role is invisible because all one sees are instuntiations of models’ (1991: 83)। বিশ্বপুঁজিবাদের কুটিল ছায়ায় আবিল ভারতবর্ষীয় সমাজ ওই অধিবাস্তবের দ্বারা আক্রান্ত। তাই আমাদের চিন্তার ধরন পর্যন্ত বদলে যাচ্ছে। আমরা টের পাচ্ছি না, কখন কীভাবে নিঃশব্দ পদচারণায় বিদূষণ আমাদের বোধ-বুদ্ধিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিচ্ছে। মোহিনী আড়াল ভেদ করার দ্রষ্টাচক্ষু আমরা হারিয়ে ফেলেছি, ভ্রমকথাকেও বরণ করে নিচ্ছি প্রাগুক্ত ‘মডেল’ বা নিয়ন্তা আকল্প হিসেবে। এই আকল্পের সাংস্কৃতিক রাজনীতি অর্থাৎ আধিপত্যবাদের কূটকৌশল সুস্মিতা সেন, ঐশ্বর্য রাই, লারা দত্তদের একাদিক্রমে

২১