পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়তে পারে তৃতীয় ভুবনে। ওই বইটিতে দেখলাম, কয়েকজন উৎসুক ইংরেজ সিলেটি লিপি তৈরিতে সহায়তা করেছেন। একে তো কাকতাল বলে নিরুদ্বিগ্ন থাকা যাচ্ছে না। নয়া উপনিবেশবাদী চক্র এভাবেই তো,নানা ধরনের সহযোগিতার আড়ালে, কাজ করে থাকে চিরকাল। অজস্র কৌনিকতায় ঋদ্ধ বাঙালি অস্তিত্বের পক্ষে যা ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য, তা-ই আবার বিচিত্র কূটাভাসের বশে নেতিবাচক বিভেদের সলতে হয়ে উঠতে পারে। তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে-র উত্তরাধিকার কোথায় থাকবে? সালাম বরকতরা ঢাকার উপভাষার জন্যে প্রাণ দেয়নি নিশ্চয়, কমলা-শচীনেরাও প্রাণ দেয়নি সিলেটি বিভাষার জন্যে। বাংলা ভাষার মৃত্যুহীন শহিদদের পতাকা এই ক্রান্তিকালেই তো নতুন মুঠোয় তুলে ধরা প্রয়োজন। তাদের মৃত্যুকে অবমাননা করতে চাইছে মৌলবাদ, অবক্ষয়ী আধুনিকতা, আধুনিকতার ভোগসর্বস্ববাদ ও আঞ্চলিক উপনিবেশবাদ। বাঙালি আবার এক জটিল সন্ধিক্ষণে পৌছে গেছে, তিন ভুবনে আলাদা-আলাদা ভাবে। যতক্ষণ এবিষয়ে অবহিত না হচ্ছি, আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিছক অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি মাত্র হবে—তা সার্বিক সত্তার পরিচায়ক হবে না।

 সংকট তাকেই বলি যখন অন্ধ-বোবা-বধির জনতায় ভরে যায় চতুম্পার্শ্ব আর তাদের ধাতব কোলাহলে ও শীৎকারে গলে-গলে পড়তে থাকে অন্ধকার। ডিশ অ্যাণ্টেনা আর ইণ্টারনেটের যুগে উত্তরপূর্ব ভারতের অর্থাৎ বাঙালির তৃতীয় ভুবনে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন আপাতদৃষ্টিতে নেই। ভৌগোলিক সীমান্ত যখন ঝাক্স, চিন্তাবিশ্বের স্বাতন্ত্র্য মুছে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপ্ত প্রতাপের আগ্রাসনে—পিণ্ডাকার ভিড়ের মধ্যে ব্যক্তিরূপ নয়, সংখ্যাচিহ্নিত অস্তিত্বই ফুটে উঠছে, বুদ্বুদের মতো মিলিয়েও যাচ্ছে। তাহলে বাঙালিত্ব কিংবা বাঙালির বিভিন্ন ভুবন নিয়ে দুর্ভাবনা করব কেন? সময়ের দুরন্ত স্রোতে শ্যাওলার মতো ভেসে যাওয়াকে মানিয়ে নিই বরং। যদি দুর্ভাবনা না করি, যদি মানিয়ে নিই—তাহলে প্রতিবেদনও বিভ্রম মাত্র হবে। তবু যে প্রতিপ্রশ্ন উত্থাপন করছি, এতেই প্রমাণিত সাংস্কৃতিক রাজনীতি আলোচনার বৈধতা।

 বাঙালিত্ব আক্রান্ত এই যথাপ্রাপ্ত বয়ানের সূত্রে আমরা পৌছে যাচ্ছি। শিলচর-ঢাকা-কলকাতার পরিসর থেকে সময়ের রাজনৈতিক মাত্রায়, তার জটিল অন্তঃস্বরে। বিশ্বায়নের দোসর আধুনিকোত্তরবাদ কল্পজীবনের হাতছানি দিয়ে সর্বত্র সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঐক্যবোধের কাঠামো ভেঙে দিচ্ছে একদিকে। অন্যদিকে সৃজনশীল সমান্তরালতা ও ইতিবাচক পার্থক্য-প্রতীতি মুছে দিয়ে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণের প্রক্রিয়াকে অবান্তর করে দিচ্ছে। বাঙালির সামূহিক অস্তিত্বে এই দুটোই সমান বিপজ্জনক। কিন্তু মঞ্চসাজের লুব্ধতায় মোহগ্রস্ত আমরা, তলিয়ে ভাবছি না কিছুই। শনাক্ত করছি না বিশ্বায়নের কৃৎকৌশলে উৎপাদিত সত্যভ্রমগুলিকে, তাদের চিত্ত-অসাড়-করে-দেওয়া পদ্ধতিগুলিকে। যারা প্রান্তিক অঞ্চলের অধিবাসী বলে প্রত্যাখ্যাত অপরের অবস্থানে খানিকটা অভ্যস্তই, তাঁদের কোনো প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা নেই বলে সবচেয়ে আগে তারা মুছে যাবেন। কিন্তু অজগর সাপের ভয়াবহ ঐক্যনীতি শেষ

৩৫