পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কার্যত তাৎপর্যহীন হয়ে পড়েছে। শিষ্টায়নের প্রবণতা আগেও ছিল উপভাষা অঞ্চলে; ইদানীং তা অতিমাত্রায় প্রকট। আরও একটি কথা এইসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন। শিষ্ট চলিত ভাষার কেন্দ্র অন্তত পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে পুরুলিয়াবীরভূম-কোচবিহার থেকে খুব একটা লক্ষণীয় দূরত্বে নেই। কার্যকরী অপরতার বোধকে বিকৃতভাবে, রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে, উসকে দিয়ে ইদানীং যদিও উত্তরবঙ্গে ‘কামতাপুরি’ নাম নিয়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক উপভাষার সম্পর্ক অস্বীকার করা হচ্ছে—ক্ষীণ বা অস্তিত্বহীন সংযোগের সংকট ওই অপর পরিসরে ছিল না কখনও। কিন্তু নোয়াখালি-চট্টগ্রাম-সিলেট এবং অবিভক্ত কাছাড় (সাম্প্রতিক অভিধা অনুযায়ী বরাক উপত্যকায়) বসবাসকারী প্রান্তিকায়িত বাঙালিদের জন্যে সংযোগের অভাব জনিত সংকট জ্বলন্ত বাস্তব। অপর পরিসরের উপলব্ধি এইসব অঞ্চলে তাই অর্জিত নয়, স্বতঃস্ফূর্ত। উপগ্রহ-প্রযুক্তির সমুদ্রোচ্ছাস এবং শিষ্টায়ন প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র এখনও বাস্তব ও অপরিহার্য সত্য।

 ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়েও কয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বরাক উপত্যকা ঔপনিবেশিক শক্তি ও আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদী বর্গের যৌথ কুটিল চক্রান্তে আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীন হয়েছি আমরা, ভারতবর্ষের বাকি অংশের সঙ্গে; কিন্তু অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সঙ্গে লড়াই আজও থামল। আজও ছেদ ঘটল না আত্মঘাতী মূঢ়তার, আত্মবিস্মৃতির, নির্লজ্জ সমঝোতা ও তোমোদ প্রবণতার। বরাকের সমাজে রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঢুকে গেছে বিবেকহীন পশ্চাত্তাপশূন্য দালাল-মানসিকতার বিষ। এই নিবন্ধ যখন লিখছি, স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, আগামী লোকগণনায় আসামের বঙ্গভাষীরা যাতে নিজেদের অসমিয়া বলে পরিচয় দেন—সেই অনুরোধ জানিয়েছে বাঙালি মা-বাবার কয়েকটি কুলাঙ্গার সন্তান। পুরননা দিনে বলা যেত, এইসব উচ্ছিষ্টজীবী মানুষ নামধারী ইতর প্রাণীদের মুখে আঁতুড়ঘরে নুন দেওয়া হয়নি কেন? এরা এবং এদের মুষ্টিমেয় সাঙ্গপাঙ্গরা অসমিয়া কেন, জুলু-হটেনটট বলে নিজেদের প্রচারিত করুক। কিছু আসে যায় না। এইসব দুকান-কাটা লোকগুলো খবরের কাগজে ঠিক এখনই বিবৃতি দিচ্ছে কেন? সামনেই আসামে নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়বে বলে? নাকি, কারণ আরও গভীরে! হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানের স্তবপ্রচারকেরা দিনে রাত্রে বেনো জল ঢুকিয়ে দিচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক মদতে। চ্যানেলে চ্যানেলে উগ্র কুৎসিত নীল বিষ প্রতীচ্যায়িত হিন্দিয়ানির সূত্রে না-পৃথিবীর হাতছানি আর উন্মত্ত ভোগবাদ দিয়ে বাঙালি ও মনুষ্যত্বের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চাইছে। সৎ অসমিয়াদের জন্যেও একই বিপদ আজ। কিন্তু অসম সাহিত্য সভার পাণ্ডারা দেয়ালের লিখন পড়তে না পেরে একচক্ষু হরিণের মতো পুরনো হরতন-ইস্কাবন দিয়ে খেলতে চাইছেন। বঙালখেদা আন্দোলন থেকে বহিরাগত বিতাড়ন উৎসব দিয়ে এঁরা

৮৭