পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সচেতন চেষ্টা করবে না। কিন্তু বরাক উপত্যকার পাঠশালাগুলিতে বাংলা বর্ণমালাও উপভাষার স্পর্শদোষ এড়াতে পারছে না।

 ছাত্র-ছাত্রীরা যখন ধাপে-ধাপে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তাদের মগজে ও অভ্যাসে বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে এই সংস্কার যে বাংলা যেমন খুশি ব্যবহারযোগ্য। কেননা প্রতিটি স্তরে প্রতিটি বিষয়ে টেক্সট বইগুলিতে বাংলা ভাষাকে দুমড়ে মুচড়ে পরিকল্পনা মাফিক বিকৃত করা হচ্ছে। অথচ পাঠ দান একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার মাত্র নয়; এতে প্রচুর সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভূতির স্তরও রয়েছে। সেসব বিঘ্নিত হয় যদি শিক্ষক-শিক্ষিকারা নির্বিচারে সর্বত্র কেবল ধ্বস্ত মর্দিত বাংলাকে বা উপভাষাকেই প্রকাশ-মাধ্যম করে তোলেন। শিষ্ট চলিত ফলে হয়ে উঠেছে আবশ্যিক অথচ কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিকল্প মাত্র।

 এই ছাত্রছাত্রীরা, এমন কি শিক্ষক-শিক্ষিকারাও, যখন জীবনের প্রয়োজনে বৃহত্তর বাঙালি পরিমণ্ডলে যান—দু-একটি বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে অন্য কেউ হীনমন্যতা। কাটিয়ে উঠতে পারেন না। এ কি আমরা ভাবতে পারি যে, উত্তরবঙ্গ (শিলিগুড়ি) কিংবা বর্ধমান বা বিশ্বভারতী বা বিদ্যাসাগর (মেদিনীপুর) বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাঠকক্ষে ঢোকার আগে এটা বলে দিচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের, ‘তোমরা বাপু আমাদের সঙ্গে বা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে অন্তত উপভাষা ব্যবহার করো না। দ্যাখো, তোমরা বাংলা পড়তে এসেছ এবং আমরাও বাংলা পড়াতে এসেছি। অতএব বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে কিংবা তার বাইরেও, মত বিনিময়ের জন্যে শিষ্ট চলিত শুদ্ধভাবে ব্যবহার করতে শেখো’! এ এক উদ্ভট পরিস্থিতি শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যা কিনা ন ভূতো ন ভবিষ্যতি। বাংলা ভাষাকে চেতনার প্রতিটি কোষে-কোষে যদি প্রতিষ্ঠিত করতে চাই এবং সর্বত্রব্যাপ্ত আক্রমণের চক্রান্তকে প্রতিহত করতে চাই, তাহলে পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বুঝতেই হবে। সিলেটি উপভাষা থাকুক আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্তরে। উনিশে মে-একুশে জুলাই-সতেরো আগস্টের রক্ত-রাঙা পথ তো সিলেটি উপভাষার জন্যে তৈরি হয়নি, বাংলা ভাষার মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্যে হয়েছিল। আমরা যেন মর্যাদার তাৎপর্য ও প্রায়োগিক দিকটা তলিয়ে ভাবি। নইলে আমরাই দায়ি হব দুঃখিনী বর্ণমালার অষ্টাবক্র দশার জন্যে।

 বরাক উপত্যকায় খবরের কাগজগুলিতে বাংলা ব্যবহারের নামে যথেচ্ছাচার চলছে। সংবাদপত্রে কাজ শুরু করার আগে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বা শিক্ষানবিশির ব্যবস্থা না থাকায় দু-তিনটে বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে সাংবাদিকদের কারও কোনও মাথাব্যথা থাকে না। বাক্য তৈরিতে কোনও মাথা-মুণ্ডু নেই; অসমিয়া কিংবা হিন্দি কিংবা সিলেটি শব্দ বা বাগবিধি ইচ্ছেমতো ব্যবহৃত হচ্ছে। বানানের কথা তো না বলাই ভালো। কয়েক দিন যেতে না যেতেই এরা নিজেদের এত কেউকেটা বলে ভাবতে শুরু করে যে ঔদ্ধত্য হয়ে যায় মাত্রাছাড়া। পেশাগত উৎকর্যের জন্যেও

৮৯