পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভুতোর কথাবার্তা ও ব্যবহার বদলাইয়া আশ্চর্যরকম নরম হইয়া আসিল এবং বিষ্ণুবাহনের সঙ্গে ভাব পাতাইবার জন্য সে হঠাৎ এমন ব্যাকুল হইয়া উঠিল যে, ব্যাপার দেখিয়া আমরা সকলেই অবাক হইয়া রহিলাম। তার পর দিনই টিফিনের সময় সে একটি ছেলেকে দিয়া বলিয়া পাঠাইল যে, “দূত হোক, পেয়াদা হোক, তাহাকে যাহা কিছু সাজিতে দেওয়া যাইবে, সে তাহাই সাজিতে রাজি আছে। শেষ দৃশ্যে রণস্থলে মৃতদেহ দেখিয়া নিষাদরাজের কাঁদিবার কথা—আমরা কেহ কেহ বলিলাম, “আচ্ছা ওকে মৃতদেহ সজিতে দাও।” বিষ্ণুবাহন কিন্তু রাজি হইল না। সে ছেলেটাকে বলিল, “জিজ্ঞাসা করে আয়, সে তামাক সাজতে পারে কি না।” শুনিয়া আমরা হো হো করিয়া খুব হাসিলাম, আর বলিলাম, “এইবার ভুতোর মুখে জুতো।”

 তার পর একদিন, অমরা হরিদাসকে দিয়া একটা বিজ্ঞাপন লিখাইলাম। হরিদাস ছবি আঁকিতে জানে, তার হাতের লেখাও খুব ভালো; সে বড়ো-বড়ো অক্ষরে একটা সাইনবোর্ড লিখিয়া দিল-

‘চন্দ্রদ্বীপের দিগ্বিজয়’
১৪ই আশ্বিন সন্ধ্যা ৬॥ ঘটিকা

আমরা মহা উৎসাহ করিয়া সেইটা স্কুলের বড়ো বারান্দায় টাঙাইয়া দিলাম। কিন্তু পরের দিন আসিয়া দেখি কে যেন ‘চন্দ্রদ্বীপ’ কথাটাকে কাটিয়া মোটা-মোটা অক্ষরে লিখিয়া দিয়াছে-“বিষ্ণুবাহন’-‘বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়’! ইহার উপর ভুতো আবার গায়ে পড়িয়া বিষ্ণুবাহনকে শুনাইয়া গেল, “কিরে খগ, খুব দিগ্বিজয় করছিস যে।” এমনি করিয়া শেষে ছুটির দিন আসিয়া পড়িল। সেদিন আমাদের উৎসাহ যেন ফাটিয়া পড়িতে লাগিল, আমরা পর্দা ঘেরিয়া তক্তা ফেলিয়া মস্ত স্টেজ বঁধিয়া ফেলিলাম। অভিনয় দেখিবার জন্য দুনিয়াসুদ্ধ লোককে খবর দেওয়া হইয়াছে, ছয়টা না বাজিতেই লোক আসিতে আরম্ভ করিয়াছে। আমরা সকলে তাড়াহুড়া করিয়া পোশাক পরিতেছি, বিষ্ণুবাহন ছুটাছুটি করিয়া ধমক-ধামক দিয়া সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া উপদেশ দিতেছে। দেখিতে দেখিতে সমস্ত যখন ঠিকঠাক হইল, তার পর ঘণ্টা দিতেই স্টেজের পর্দা সরসর করিয়া উঠিয়া গেল, আর চারিদিকে খুব হাততালি পড়িতে লাগিল।

 প্রথম দৃশ্যেই আছে, চন্দ্রদ্বীপ তাহার ভাই বজ্রদ্বীপের খোঁজে আসিয়া নিষাদরাজার দরজায় উপস্থিত হইয়াছেন এবং খুব আড়ম্বর করিয়া নিষাদরাজকে “আয় শত্রু আয়” বলিয়া যুদ্ধে ডাকিতেছেন। যখন তলোয়ার নিয়া দরজায় মারা হইবে তখন নিষাদের দল হুংকার দিয়া বাহির হইবে আর একটা ভয়ানক যুদ্ধ বাধিবে। দুঃখের বিষয়, বিষ্ণুবাহনের বক্তৃতাটা আরম্ভ না হইতেই সে অতিরিক্ত উৎসাহে ভুলিয়া খটাং করিয়া দরজায় হঠাৎ এক ঘ মারিয়া বসিল। আর কোথা যায়! অমনি নিষাদের দল ‘মার্ মার্’ করিয়া আমাদের এমন ভীষণ আক্রমণ করিল যে, নাটকে যদিও আমাদের জিতিবার কথা, তবু আমরা বক্তৃতাটক্তৃতা ভুলিয়া যে যার মতো পিট্টান দিলাম। বাহিরে আসিয়া বিষ্ণুবাহন রাগে গজরাইতে লাগিল। আমরা বসিলাম, “আসল নাটকে কি আছে কেউ তো তা জানে না—নাহয়, চন্দ্রদ্বীপ হেরেই গেল।” কিন্তু বিষ্ণুবাহন কি সে কথা শোনে? সে লাফাইয়া ধমকাইয়া হাত-পা

১২৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২