পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অর্জুনের মুখে পাকা গোঁফদাড়ি দিয়ে খুব সহজেই ভীষ্ম করে দেওয়া যাবে। আর রথটা হবে সিংহাসন, তার উপর যুধিষ্ঠিরকে বসিয়ে দিয়ো। আর ঐ যে গরুড় আর সাপ, ঐটে একটু বদলিয়ে দিলেই গদা হাতে ভীম হয়ে যাবে। আর শিশুপাল তো আছেই।—ঐ গাছটাতে একটু নাক মুখ ফুটিয়ে দিলেই হবে। তার পর রাজসূয় যজ্ঞের কয়েকটা রাজাকে দেখালেই- ব্যস!' কথাটা কালাচাঁদের পছন্দ হল না, তাই আমি অনেক ভেবেচিন্তে আবার বললাম, 'তা হলে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ করনা কেন? ঐ রথটা হবে জনমেজয় আর কৃষ্ণকে জটা দাড়ি দিয়ে পুরুতঠাকুর বানিয়ে দাও। সুদর্শন চক্রটা হবে ঘিয়ের ভাঁড়। যজ্ঞের আগুনের মধ্যে তিনি ঘি ঢালছেন। ঐ ধোঁয়াগুলো মনে কর যজ্ঞেরই ধোঁয়া। একটা সাপ আছে, আরো কয়েকটা একে দিও। আর অর্জুনকে কর আস্তীক—সে হাত তুলে তক্ষককে বলছে, ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ!' আর ঐ চামচিকেটা-মানে গরুড়টা-ওটাকে মুনিটুনি কিছু একটা বানিয়ে দিয়ো।' পতাকাটাকে কিরকম করতে হবে সেইটা বলতে যাচ্ছি, এমন সময় কালাচাঁদ আমায় এক ধাক্কা দিয়ে বলল, 'থাক থাক আর তোমার বিদ্যে জাহির করে কাজ নেই। সর দেখি!'

 “আমি বললাম, ‘তা অত রাগ কর কেন ভাই? আমি তো আর বলছি না যে আমার পরামর্শমতো তোমাকে চলতেই হবে। পছন্দ হয় কোরো, না হয় কোরো না-ব্যস্। এর মধ্যে আবার রাগারাগি কর কেন? আমার কথামতো না করে অন্য-একটা কিছু কর-না। মনে কর, ওটাকে সমুদ্রমন্থন করে দিলেও তো হয়। ঐ ধোঁয়াওয়ালা বড়ো গাছটা মন্দরপর্বত, রথটা ধন্বন্তরী কিম্বা লক্ষী-মন্থন থেকে উঠে এসেছেন। ওদিকে সুদর্শন চক্রটা চাঁদ হতে পারবে। অর্জুনের পেছনে কতগুলো দেবতা এঁকে দাও আর এদিকে কৃষ্ণ আর চামচিকের দিকে কতগুলী অসুর- কথাটা ভালো করে বলতে না বলতেই কালার্টাদ আমার কান ধরে মারতে লাগল। আচ্ছা দেখ দেখি কি অন্যায়। আমি বন্ধুভাবে দুটো পরামর্শ দিতে গেলাম—তা তোমার পছন্দ হয় নি বলেই আমায় মারবে? যা বলেছি সব শুনলে তো, এর মধ্যে এত রাগ করবার কি হল বাপু?”

 বাস্তবিক, কালাচাঁদের এ বড়ো অন্যায়-সে রাগ করিল কিসের জন্য। নিধিরাম তাহাকে মারে নাই, ধরে নাই, বকে নাই, গাল দেয় নাই, চোখ রাঙায় নাই, মুখ ভ্যাংচায় নাই—তবে তার রাগ করিবার কারণটা কি?

 ব্যাপারটা কি বোঝা গেল না, তাই সন্ধ্যায় সবাই মিলিয়া কালাচাঁদের বাড়িতে গেলাম। আমি বলিলাম, “ভাই কালাচাঁদ, আমরা তোমার সেই ছবিটা দেখতে চাই। সেই যে সমুদ্র লঙ্ঘন না কি যেন?” রমাপ্রসাদ বলিল, “দ্যুৎ, সমুদ্র লঙ্ঘন কিসের? অগ্নি পরীক্ষা।” আর একজন কে যেন বলিল, “না না কি একটা বধ।” কেন জানি না, কালাচাঁদ হাঁ হাঁ করিয়া একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। “যাও যাও ইয়ার্কি করতে হবে না” বলিয়া সে তাহার ছবির খাতাখানি ফড়্‌ফড়্ করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল—আর রাগে গজরাইতে লাগিল। আমরা হতভম্ব হইয়া রহিলাম। সকলেই বলিলাম, “কালাচাঁদের মাথায় বোধ হয় একটু পাগলামির ছিট আছে। নইলে সে খামখা এত রাগ করে কেন?”

সন্দশ-আষাঢ়, ১৩২৫
১৩৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২