পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কাগজওয়ালারা এই পাটালিকে আবার জলে ঘুটিয়া মণ্ড তৈরি করেন, সেই মণ্ডকে সিদ্ধ করিয়া ঝোলের মতো করেন। এই ঝোল লোহার নলে করিয়া কাগজের কলের মধ্যে ঢালিয়া দেওয়া হয়। কল একদিকে কাঠ, ঘাস বা নেকড়ার ঝোল খাইতে থাকে আর একদিকে চার-পাঁচ মাইল কম্বা কাগজের থান বাহির করিতে থাকে। সমস্ত দিনরাত কল চলিলে বারো হাত চওড়া আড়াই মাইল লম্বা একখানা কাগজের থান বাহির হয়। তাহার পরে গরম জলের চৌবাচ্চার মধ্যে সেই মণ্ড গুলিয়া ঝোল তৈয়ারি হয়।

 ঝোলটা যখন কলের মধ্যে চালানো হয় তখন সেটা একটা লম্বা চলন্ত ছাঁকনির উপর পড়ে। ছাঁকনিটা চলিতে থাকে আর মাঝে মাঝে কেমন একটা ঝাকানি দেয়, তাহতে জল ঝরিয়া যায় এবং ঝোল ক্রমে চাপ বাঁধিয়া আসে। এমনিভাবে চলিতে চলিতে ঝোলটা কলের আরেক মাথায় আসিয়া পড়ে—সেখানে লুচি বেলিবার বেলুনের মতো অনেকগুলা ‘রোলার’ খাটানো থাকে। ছাঁকনিটা এইখানে আসিয়া ঝোলটাকে একটা রোলারের গায়ে ছিটকাইয়া দেয়। কিন্তু সে ঝোল আর এখন ঝোল নাই। এখন তাহার চেহারা অনেকটা ভিজা বুটিং কাগজের মতো। এতক্ষণে তাহাকে ঠিক কাগজ বলা চলে।

 রোলারের গায়ে কাগজ লাগিবামাত্র রোলার তাহাকে টানিতে থাকে। তার পর সেই টানে কাজও অনেকগুলি গোলারের মধ্যে ঘুরপাক খাইতে থাকে। এমনি করিয়া কাগজকে ক্রমাগত চাপ দিতে হয়, সুচির মতো বেলিতে হয়, ঘষিতে ও পালিশ করিতে হয়, তাহাতেই কাগজ ক্রমে পাতলা ও মোলায়েম হইয়া আসে।

 অবশ্য এই সমস্ত কাজই কলে আপনা-আপনি হইতে থাকে। দু-একজন লোক থাকে তারা কেবল দেখে সমস্ত কল ঠিকমতো চলিতেছে কিনা। চব্বিশ ঘটা সমান হিসাবে কাজ চলে। কলের এক মাথায় অনবরত ঝোল আসিয়া পড়িতেছে—সেই ঝোলসুদ্ধ ছাঁকনি কেবলই ছুটিতেছে, হাঁকনি হইতে জমাটবাঁধা কাগজ ক্রমাগতই রোলারের উপর লাফাইয়া পড়িতেছে, রোলারেরও বিশ্রাম নাই, সেও কাগজ টানিতেছে আর ঠেলিয়া বাহির করিতেছে।

সন্দেশ-জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১
লুপ্ত শহর

 ‘লুপ্ত শহর’ লিখিলাম বটে—কিন্তু আসলে সে শহর এখনো একেবারে লোপ পায় নাই। শহরের পথঘাট, দোকানপাট, এমন-কি, ঘরের আসবাব পর্যন্ত অনেক জায়গায় ঠিক রহিয়াছে অথচ সে শহর আর এখন শহর নাই—সেখানে লোক থাকে না, কোনো কাজ চলে না—মাঝে মাঝে নানা দেশ হইতে লোক আসে কিন্তু সেও কেবল তামাশা দেখিবার জন্য।

 পম্পেয়াই-আড়াইহাজার বৎসরের পুরাতন শহর, ইটালির পাগলা পাহাড় ভিসুভিয়াস তাহাতে ছাই চাপা দিয়া আগুন ঢালিয়া একেবারে শহরকে শহর বুজাইয়া দিয়াছিল। প্রায় আঠারোশত বৎসর এমনিভাবে শহর চাপা পড়িয়াছিল—সেখানে যে শহর ছিল সেই কথাই লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল—কারণ বাহির হইতে শহরের চিহ্নমাত্র দেখা যাইত

১৫২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২