পাতা:হারানো খাতা - অনুরূপা দেবী.pdf/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮০
হারানো খাতা।

তার সঙ্গে কুব্যবহার করতেও দ্বিধা করছে না। তারই রক্ষার ভার তুমি যদি নাও, তা হলে আমি নিচিন্ত হতে পারি। আমি তোমায় চিনেছি, তুমি আমার চেয়েও এ কার্য্যের বেশী উপযুক্ত। আমার নিজের মধ্যেও একটা লােভের আগুণ, জ্বলন্ত হ’য়ে রয়েছে। কিন্তু তুমি ওকে ‘মা’ বলেছ—তুমিই ওকে আমার কাছ থেকেও রক্ষা করতে পারবে। আমি তো ও-চোক নিয়ে প্রথম থেকে ওকে দেখিনি!”

 নিরঞ্জন অত্যন্ত আগ্রহ ও আনন্দের সহিত তার এ নূতন চাকরী এক মুহূর্ত্তেই স্বীকার করিয়া লইল। তখন স্থির বিজলীর মত চোকদুটী নরেশের সদ্যচিন্তাভারবিমুক্ত ঈষৎ প্রসন্নমুখে স্থাপন করিয়া সুষমা কহিল, “কিন্তু কার ভার ওঁকে নিতে হচ্ছে, সেটা আমার যাবার আগে থেকেই জেনে নেওয়া উচিত যে?”

 এই বলিয়া নরেশকে বাক্যবিমুখ দেখিয়া সে নিজেই নিরঞ্জনের দিকে ফিরিয়া অকম্পিত কণ্ঠে কহিতে লাগিল, “আমি একজন অতি হীনজীবী পতিতার মেয়ে, বাবা! সমাজে আমার জায়গা নেই বলে, অত্যন্ত ছােট বেলা থেকে রাজাবাহাদুর দয়া করে আমায় একটা স্বতন্ত্র বাড়ীতে রেখে লালন পালন করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষে যা হয়ে থাকে সেই ধরে বিচার করে, লােকে আমার জন্য ওঁর দেবচরিত্রেও কালি মাখাতে ছাড়ে নি। স্বাধীনভাবে কোন চাকরী নিয়ে থেকে ওঁর দেওয়া আশ্রয় ছাড়লে হয়ত কালে আমার ও ওঁর নাম স্বতন্ত্র হয়ে পড়বে, এই আশা করেছিলুম, হিতে বিপরীত হলাে! ভয় পেয়ে আজ এখান অবধি—আমার দুষ্প্রবেশ্য জেনেও জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে এসেছিলেম। আমি হয়ত ওঁর সকল সুখের রাহু।— বলিতে বলিতে আকস্মিকোদিত বাস্পবেগে কণ্ঠরােধ হইয়া সুষমা চুপ করিয়া দৃষ্টি ভূমিলগ্ন করাতে তার চোখের জল গােপনেই সাদা পাথরের মেজের কঠিন বক্ষ আর্দ্র করিয়া নিঃশব্দে ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।