পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

එ68 বিভূতি-রচনাবলী সে কথা পরে বলচি। না, এখন নেই ধরে নিতে পারেন । কেন যে নেই, তার সঙ্গে এই গল্পের একটা সম্বন্ধ আছে, গল্পটা শুনলেই বুঝবেন। হুগলী জেলার কোনো এক গ্রামে আমার মামার বাড়ি ছিল । ছেলেবেলায় যখন সব প্রথম মায়ের সঙ্গে সেখানে যাই, তখন আমার বয়েস বছর পাঁচেক । আমাদের* মামার বাড়ির পাড়ায় আট নয় ঘর ব্রাহ্মণের বাস, ঘোষাঘোষ বসতি, এক চালে আগুন লাগলে পাড়াসন্ধ পড়ে যায়, এমন অবস্হা । কোঠাবাড়ি ছিল কেবল আমার মামাদের, আর সব খড়ের ছাউনি, ছোট-বড় আটচালা ঘর, এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া যাবার পথে একটা বড় আম-কাটালের বাগান, বনজঙ্গল, সজনে গাছ ও দু-একটা ডোবা । বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেকদর গেলে তবে ও-পাড়ার প্রথম বাড়িটা। সেই বনজঙ্গলের মধ্যে কাদের একটা কোঠাবাড়ি খানিকটা গাঁথা হচ্চে । সে-বার কিছুদিন থেকে চলে আসবার পর আবার যখন মামার বাড়ি গেলাম, তখন আমার বয়স আট বছর । গ্রামটা অনেক দিন পরে দেখতে বেরিয়ে চোখে পড়ল, এ-পাড়া ও ও-পাড়ার মধ্যে বী-দিকে ডোবার ধারের একটা জায়গা । একটু অবাক হয়ে গেলাম । ডোবার পাড়ের জঙ্গল অনেকটা কাটানো, কাদের একটা কোঠাবাড়ি খানিকটা গাঁথা অবস্হায় দাঁড়িয়ে, কিন্ত মনে হ’ল অনেক দিন গাঁথনির কাজ বন্ধ আছে, যে-জন্যই হোক, কারণ ভিতের গায়ে ও ঘরের মেঝেতে ছোট-বড় ভটিশেওড়ার গাছ গজিয়েচে, চুণ-সুরকী মাখার ছোট থানাতে পয্যন্ত বনমালোর চারা । মনে পড়ল, সে-বার এসে বাড়িটা গাঁথা হচ্চে দেখেছিলাম। এখনও গাঁথা শেষ হয়নি তো ? কারা বাড়ি তুলচে ? ছনটে গিয়ে দিদিমাকে জিজ্ঞেস করলাম । —কারা ওখানে বাড়ি করচে দিদিমা, সে-বার এসে দেখে গিইচি, এখনও শেষ হয়নি ? —তোর এত কথাও মনে আছে “ও তোর ভ"ডুলমামা বাড়ি করচে, এখানে তো থাকে না, তাই দেখাশোনার অভাবে গাঁথনি এগাচ্চে না । আমার ভারী কৌতুহল হ’ল, সাগ্রহে বললাম, ভন্ডুলমামা কোথায় থাকে দিদিমা ? ভ"ডুলমামা কে ?” —ভন্ডুল রেলে চাকরি করে, লালমণিরহাটে না কোথায় । আমাদের গাঁয়েই ছেলেবেলায় থাকত, বাড়িঘর তো ছিল না। ও-পাড়ার মাখনয্যে-বাড়ির ভাগ্নে, চাকরিবাকার করছে, ছেলেপলে হয়েচে, একটা আস্তানা তো চাই ? তাই টাকা পাঠিয়ে দ্যায়, মল্লখয্যেরা মিসরী লাগিয়ে ঘরদোর শরন করে দিয়েচে, নিজে ছটিতে এসে মাঝে মাঝে দেখাশুনো করে— আমি ছাড়বার পাত্র নই, বললাম,—তবে বাড়ি গাঁথা হচ্চে না কেন ? মলখয্যেরা তো দেখলেই পারে ? g —তা নয়, সব সময় তো টাকা পাঠাতে পারে না ? যখন পাঠায়, তখন মিস্ত্রী লাগানো হয় । কি জানি কেন সেই থেকে এই ভন্ডুলমামা ও তাঁর আধ-গাঁথা বাড়িটা আমার মনে একটা অদ্ভুত স্থান অধিকার করে রইল। রংপকথার রাজপত্রের মতই এই ভঙুলমামা হয়ে রইলেন অবাস্তব, পশের অতীত, দশনের অতীত, এক মানস-রাজ্যের অধিবাসী, তাঁর চাকরির স্হান লালমণির হাট, মায় তাঁর ছেলেমেয়েসন্ধ । তাঁর টাকা পাঠাবার ক্ষমতা বা অক্ষমতাও যেন কোথায় আমার ব্যক্তিগত সহানুভুতির বিষয়ীভুত হয়ে দাঁড়াল, অথচ কেন এসব হ’ল তার কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ আজও মনের মধ্যে খুজে পাই না । কতবার দিদিমাদের চিলেকোঠার ছাদে শায়ে দিদিমার মুখে রংপকথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক মনে ভেবেচি-লালমণিরহাট থেকে ভণ্ডুলমামা আবার কবে টাকা পাঠাবে বাড়ি