পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৬ বিভূতি-রচনাবলী কত কি বন্তলতা বুলচে, ডাইনে রঞ্জন মেঘন্তপ, আবার একটা জায়গায় আধভাঙা একটা রামধন্থ । বেলেডাঙার মাঠে নেমে সবুজ ঘাসের একধারে বড় সুন্দর একটা ঝোপ । এদিকটা কখনও আসিনি। কতক্ষণ মাঠের মধ্যে ঘাসের ওপর শুয়ে রইলুম। মটরলতা তো যেখানে সেখানে—নতুন পাতার সম্ভার নিয়ে দুলচে, প্রতি ঝোপের মাথা থেকে—আমার কি জানি কেন ভারী আনন্দ হয় নতুন কচি মটরলতা দেখলে । ওর সঙ্গে যেন কিসের যোগ আছে আমার। আজ সকালে জগে৷ আর শুটকে যখন কুঠীর মাঠের গাছটাতে পেয়ারা পাড়চে আমি একটা মটরলতার ঝোপের তলায় বসলুম—নতুন এক ধরণের চওড়া পাতা নরম ঘাসের ওপরে। সে এক অপূৰ্ব্ব অনুভূতি। তার বর্ণনা দেওয়া যায় না—মনের আনন্দই তার চরম প্রকাশ । আমি ডায়েরীতে অনেক বারই লিখি—“এ আনন্দের তুলনা নেই।" হয়ত একঘেয়ে হয়ে যায় কথাট, কিন্তু আনন্দটা যে একঘেয়ে হয় না । যে আননা মনকে ভরিয়ে দেয়, তা সব সময়ে, সৰ্ব্বকালে এক। যখনই পাই, তখনই মনে হয় এ বুঝি নতুন, এমনটা আর কখনও বুঝি হয়নি। সেই যে নিত্যনূতন চির অক্ষয় আনন্দ, তার কি ভাবে বর্ণনা দেব একমাত্র ঐ কথা ছাড়া যে "এর তুলনা নেই’। জীবন যে বহু আনন্দমুহূর্তের সমষ্টি, তাদের পৃথক পৃথক বর্ণনা নেই, তারা চির নবীন, শাশ্বত, অক্ষয়, অব্যয়—কাজেই তাদের তুলনা নেই। সত্যিই তো তাদের তুলনা আর কিসের সঙ্গে দিতে পারি? অন্ত অন্ত দিনের আনন্দের সঙ্গে ? কিন্তু তারা তো তখন ক্ষীণ স্মৃতিতে পৰ্য্যবসিত—বর্তমানে যা পাচ্চি, তাই তখন বড়। এত শীগগির যে আমায় আবার শিলং আসতে হবে, তা ভাবিনি। কিন্তু সুপ্রভা আসতে লিখলে, আর আমারও একটা সুযোগ উপস্থিত হল আসবার। কাজেই চলে এলুম। কাল বিকেলে ট্রেনে সময়টা কি চমৎকার কেটেচে! কত নতুন অনুভূতি, কত নতুন চিন্তা! নৈহাটির কাছাকাছি যখন গাড়িখান এল, তখন মনে হল, এখান থেকে সোজা বারাকপুর কতটুকুই বা অরি, এখন দুপুরবেল, আমাদের বকুলতলায়, বিলবিলের ধারে ছায় পড়ে গিয়েচে, খুকু এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েচে, বৃহস্পতিবার আজ গোপালনগরের হাট, সব লোক হাট করতে যাচ্চে, কত গ্রামে বাশবনের ছায়ায় ঢাকা কত পল্লীকুটিরে কিশোরী মেয়েরা প্রেমের রঙীন স্বপ্নজাল বুনে ঘুরে বেড়াচ্চে ; খুটির কাছে বসে চলে যাবার সময় চেয়ে বসে থাকার, নদীর ধারে কত বন-সিমলতার আড়ালে চোরা চাউনি ও হাসির কত ঢেউ–এই সব ছবি মনে আসে। বিকেলে তারা জলে নেমেচে গা ধুতে। পাৰ্ব্বতীপুর এসে এসে যেন সব চেনা পুরোনো হয়ে গিয়েচে । গাড়িতে বেশ জায়গা ছিল। ট্রেনে ঘুমও হল খুব । লালমণিরহাটে নেমে জেলি ও পাগলার খোজ করলুম। অত রাত্রে কোথায় পাব ? ভোর হল রঙ্গিয়া জংশনে, এখানেই প্রতিবারে ভোর হয়। আর যখনই এপথে এখানে এসেচি, বৃষ্টিছাড়া দেখিনি কখনও। ভিজে সঁ্যাতসেঁতে জলাভূমি আর ফার্ণ গাছের বন, কাদাভরা মাটির পথ-ঘাট, কলার ঝাড়, নীচু নীচু খড়ের বাড়ি। ব্ৰহ্মপুত্র কুলে কুলে ভরা। কি ঠাণ্ডা জল ! জলে নেমে মুখে মাথায় জল দিয়ে তৃপ্তি হল ভারী। টিপ, টিপ, বৃষ্টি পড়চে, মেঘমেদুর আকাশ, ওপারের পাহাড়ে কুয়াসার মত মেঘ জমে রয়েচে । গৌহাটি-শিলং মোটরবাসে ত্রিপুরার মহারাণীর একদল পরিচারিক উঠল—তাদের কথাবাৰ্ত্তা বিন্দুবিসর্গও বুঝিনে—মোটর যেমন পাহাড়ের পথে উঠল—অমনি ওরা সবাই সামনের বেঞ্চিতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল—সবারই নাকি মাথা ঘুরচে। বেশ গরম, নংপোতে এলুম তখনও