পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী সকল সভ্যতারই মূল মহত্বহুত্রটি চিরন্তন এবং তাহার বাহ আয়তনটি সাময়িক ; তাহা মূলস্বত্রকে অবলম্বন করিয়া কালে কালে পরিবর্তিত হইয়া চলিয়াছে। যুরোপীয় সভ্যতার বাহ অবয়বটি যদি আমরা অবলম্বন করি, তবে আমরা ভুল করিব। কারণ, যাহ। ইংলণ্ডের ইতিহাসে বাড়িয়াছে, ভারতের ইতিহাসে তাহার স্থান নাই। এই কারণেই বিলাতে গিয়া আমরা ইংরেজের বাহ আচারের যে-অনুকরণ করি, এ দেশে তাহা অস্থানিক অসাময়িক বিদ্রপমাত্র। কিন্তু সেই সভ্যতার চিরন্তন অংশটি যদি আমরা গ্রহণ করি, তবে তাহা সর্বদেশে সৰ্বকালেই কাজে লাগিবে । তেমনই ভারতবর্ষীয় প্রাচীন আদর্শের মধ্যেও একটা চিরন্তন এবং একটা সাময়িক অংশ আছে। যেটা সাময়িক সেটা অন্তসময়ে শোভা পায় না । সেইটেকেই যদি প্রধান করিয়া দেখি, তবে বর্তমান কাল ও বর্তমান অবস্থা দ্বারা আমরা পদে পদে বিড়ম্বিত উপহসিত হইব । কিন্তু ভারতবর্ষের চিরন্তন আদর্শটিকে যদি আমরা বরণ করিয়া লই, তবে আমরা ভারতবর্ষীয় থাকিয়াও নিজেদের নানা কাল নানা অবস্থার উপযোগী করিতে পারিব । এ কথা যিনি বলেন, ভারতবর্ষীয় আদর্শে লোককে কেবলই তপস্বী করে, কেবলই ব্রাহ্মণ করিয়া তুলে, তিনি ভুল বলেন এবং গর্বচ্ছলে মহান আদর্শকে নিনা করিয়া থাকেন। ভারতবর্ষ যখন মহান ছিল, তখন সে বিচিত্ররূপে বিচিত্রভাবেই মহান ছিল । তখন সে বীর্ষে ঐশ্বর্ষে জ্ঞানে এবং ধর্মে মহান ছিল, তখন সে কেবলই মালাজপ করিত না । তবে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতায় আদর্শের বিভিন্নতা কোনখানে। কে কোনটাকে মুখ্য এবং কোনটাকে গৌণ দেখে তাহা লইয়া। ভালোকে সব সভ্যদেশই ভালো বলে কিন্তু সেই ভালোকে কেমন করিয়া সাজাইতে হইবে, কোনটা আগে বসিবে এবং কোনটা পরে বসিবে সেই রচনার বিভিন্নতা লইয়াই প্রভেদ । যেমন সকল জীবের কোষ-উপাদান একই-জাতীয় কিন্তু তাহার সংস্থান নানাবিধ, ইহাও সেইরূপ । কিন্তু এই সংস্থানের নিয়মকে অবজ্ঞা করিবার জো নাই । ইহা আমাদের প্রকৃতির বহুকালীন অভ্যাসের দ্বারা গঠিত । আমরা অল্প কাহারও নকল করিয়া এই মূল উপাদানগুলিকে যেমন খুশি তেমন করিয়া সাজাইতে পারি না ; চেষ্টা করিতে গেলে এমন একটা ব্যাপার হইয়া উঠে, যাহা কোনো কর্মের হয় না। এইজন্য কোনো বিষয়ে সার্থকতালাভ করিতে হইলে আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রকৃতিকে উড়াইয়া দিতে পারিব না। তাহাকে অবলম্বন করিয়া তাহারই আহুকুল্যে আমাদিগকে মহত্ত্ব লাভ করিতে হইবে ।