পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৩

পিলখানার আরও কথা

সাক্ষাতকারঃ মোঃ আশরাফ আলী সরদার

১২-৪-১৯৭৪

 ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস ছিল। ঐ দিন আমরা প্রস্তুত ছিলাম কোন একটা নির্দেশ পাবার অপেক্ষায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোন নির্দেশ পাইনি। তারপর ২৪শে মার্চ আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পিলখানার প্যারেড গ্রাউণ্ডের বটবৃক্ষের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এবং সে পতাকার উর্দুতে লেখা ছিল, “পশ্চিমারা আবি বাংলা ছোড়কে ভাগ যাও, নেহি ত এধারই তোম লোগ কো কবর বানায়েগা।”

 পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ পতাকা দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং ঐ পতাকা নামিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়। এই পতাকা উত্তোলনের সংবাদ সিগনাল-এর বেতার মারফত সমস্ত সেক্টর, উইং এবং চৌকিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবং তারাও বিকেলে খবর দিল যে তারাও পতাকা উত্তোলন করেছে। যশোর থেকে বেতারে খবর আসল যে সেখানকার বাঙ্গালী ইপিআররা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সামরিক সালাম (গার্ড অব অনার) দিয়ে পতাকা উত্তোলন করেছে।

 ২৪শে মার্চ রাতে পিলখানায় অবস্থিত সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে নিরস্ত্র করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদেরকে বলে যে, শেখ সাহেবের ৭ই মার্চের ঘোষিত চার দফা ইয়হিয়া খান মেনেছে এবং শিগগিরই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। দেশে এখন শান্তি বিরাজ করছে। সুতরাং সবাই অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্রাম করুন।

 ২৫শে মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপরোক্ত ভূয়া আশ্বাসে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু যখন শুনতে পারলাম যে নরঘাতক ইয়াহিয়া তার দলবল নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ঢাকা ত্যাগ করেছে তখন আমি নায়েক সুবেদার শহীদ শমসুল হক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি সেদিন কোয়ার্টার গার্ড ডিউটি অফিসার ছিলেন। তিনি আমাকে বাইরে গিয়ে সংবাদ নিতে নির্দেশ দিলেন। তখন রাত প্রায় আটটা। আমি সরাসরি ইকবাল হলে যাই। কিন্তু সেখানে কোনো ছাত্রনেতাকে পেলাম না। আমি সেখান থেকে সুবেদার শহীদ জহীরউদ্দিন মুন্সীর বাড়িতে যাই। তাঁকে সমস্ত বিষয় অবগত করাই। তিনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করে নায়েক নূর হোসেনের সঙ্গে শেখ সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা হন। তিনি আমাকে কি করতে হবে না হবে পরে জানাবেন বলে বললেন। আমি এবং হাবিলদার শহীদ বেলায়েত হোসেন রাত এগারোটা পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষায় সিগনাল ওয়র্কশপে বসে থাকি। আমরা দুজন আমাদের সিগনাল-এর লোকজনকে কিছু একটা খবর আসবে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। এবং ১৫ শাখার জনৈক সিপাহীকে এ সংবাদ পৌঁছে দেই। এছাড়া আমরা উভয়ে আমাদের অস্ত্রাগারের ভারপ্রাপ্ত এনসিও শহীদ নায়েক হাসেমকে জিজ্ঞাসা করি যে, অস্ত্রাগারের কোনো ডুবলিকেট চাবি তৈরি হয়েছে কিনা যা আগে আপনাকে বলা হয়েছিল। তিনি বললেন যে, তার কাছে ডুপলিকেট চাবি আছে। এই সংবাদ আমরা শহীদ নায়েক সুবেদার শামসুল হক সাহেবকে কোয়ার্টার গার্ডে গিয়ে জানাই। তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে কোন রকম হামলা হলে প্রত্যেকে অনতিবিলম্বে অস্ত্রাগারে চলে আসবে। এখানে আমি উপস্থিত থাকব, তোমরা লাইনে গিয়ে বিশ্রাম নাও এবং দুজন প্রহরী নিয়োগ কর। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সে সুযোগ আসেনি।

 ২৫শে মার্চ দিনগত রাত ১টা পাঁচ মিনিটে প্রথম গুলির আওয়াজ হয়। আমরা প্রত্যেকেই সামরিক পোশাকে ব্যারাকে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমাদের গ্রহরী আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলে যে পশ্চিমারা আমাদেরকে আক্রমণ করেছে। তখন আমরা সবাই পূর্ব নির্দেশ মতো অস্ত্রাগারে যাবার জন্য বের হয়ে পড়ি। কিন্তু দেখতে পেলাম গুলির আগেই তারা সমস্ত পিলখানাকে অস্ত্রাগারসহ দখলে নিয়ে নিয়েছে। আমরা যখন বাইরে আসলাম তখন চারিদিক থেকে এলএমজি/ এসএমজি ব্রাশ ফায়ার আমাদের উপর আসতে থাকে। তখন আমরা