রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৪

উইকিসংকলন থেকে

(৪)

গৌড়াধিপের পরাজয়

 জয়ন্তী যুদ্ধের পর শ্রীহট্টে কালনাজির স্থাপিত হইয়াছিল—এইবার কালনাজিরের ডাক পড়িল। কালনাজির বীর পুরুষ। মহারাজ তাঁহাকে প্রধান সেনাপতিরূপে চট্টলে পাঠাইয়া দিলেন। কালনাজির আসিয়া দেখেন ত্রিপুর সৈন্যের মধ্যে বড়ই উৎসাহের অভাব, সেনাপতিদের উঠাইয়া নেওয়ায় ইহারা দমিয়া গিয়াছিল। কালনাজির সৈন্যগণকে চাঙ্গা করিয়া তুলিলেন। তারপর ভীষণ সংগ্রাম বাঁধিল। নাজিরের আগমনে পাঠান সৈন্য কোমর বাঁধিয়া যুদ্ধে নামিল—অস্ত্রের ঝনৎকার ও বন্দুকের আওয়াজে কানে তালা লাগিয়াছিল। রক্ত নদী বহিয়া গেল, হাতিগুলি কালো মেঘের ন্যায় রণক্ষেত্র ছাইয়াছিল এবং মেঘনাদের ন্যায় মুহুর্মুহু গর্জ্জন করিতেছিল। নাজির সেনাপতি রণমদে মত্ত হইয়া ত্রিপুর সৈন্যের পুরোভাগে থাকিয়া যুদ্ধ চালনা করিতেছিলেন, তখন সন্ধ্যা ঘনীভূত হইয়াছে এমন সময়ে পাঠানের অস্ত্রাঘাতে নাজির প্রাণত্যাগ করিলেন। সেনানীর মৃত্যুতে ত্রিপুর সৈন্যের বিজয় উল্লাসে বাধা পড়িয়া গেল, পাঠানের জয়ধ্বনিতে দিগন্ত কম্পিত হইতে লাগিল। ত্রিপুরসেনা সন্ধ্যার অন্ধকারে কোথায় যে গা ঢাকা দিল তাহার খোঁজ পাঠানেরা আর লইল না। রণশ্রান্ত হইয়া তাহারা গড়ের ভিতরে ঢুকিয়া পড়িয়া আহার বিহারে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

 এদিকে ত্রিপুরসেনা শৈলমালার নীচে জমাট বাঁধিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল—এখন উপায়? পরাজিত হইয়া রাজধানীতে প্রবেশ করিলে সকলেরই মাথা কাটা যাইবে, তার চাইতে এখানেই প্রাণ দেওয়া ভাল। এইরূপ মরিয়া হইয়া তাহাদের দলপতি এক ফন্দী আঁটিল, গড়ের যে দিকটা পাহাড়ের গায়ে ঠেকিয়া আছে এবং দুর্ল্লঙ্ঘ্য বলিয়া মাত্র জন কয় প্রহরী রহিয়াছে, তাহার নীচ দিয়া এক সুড়ঙ্গ কাটিয়া একেবারে গড়ের প্রবেশ-পথে পৌঁছান যাইবে। আজ রাত্রেই সুড়ঙ্গ করিয়া গড়ে প্রবেশ করিতে হইবে কারণ পাঠানেরা বুঝিয়াছে ত্রিপুর সৈন্য দেশে পলাইয়াছে, তাই নিশ্চিন্ত মনে গভীর নিদ্রায় ঢলিয়া পড়িবে। যেমন কথা তেমনি কায! তিন হাজার সৈন্য সুড়ঙ্গ খনন করিতে লাগিয়া গেল, আর ঐদিকে শ্রান্ত পাঠানেরা নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতে লাগিল। গভীর অন্ধকারের মধ্যে ত্রিপুরসেনা পিঁপড়ার স্রোতের ন্যায় পিল্ পিল্ করিয়া সুড়ঙ্গ মুখে একেবারে দুর্গদ্বারে উপস্থিত! যে প্রহরীরা পাহারায় ফিরিতেছিল, তাহারা ব্যাপার বুঝিবার পূর্ব্বেই নিহত হইয়া গেল। তখন মুক্ত দ্বার পথে ত্রিপুরসেনা গড়ের মধ্যে ঢুকিতে লাগিল, ভিতরের প্রহরীরা এই কাণ্ড দেখিয়া দামামা পিটিয়া দিল। তখন এক মহা সোরগোল উঠিল। যে দিকেই পাঠান চোখ কচ্‌লাইয়া জাগিয়া 


তখন মুক্ত দ্বার পথে ত্রিপুরসেনা গড়ের মধ্যে ঢুকিতে লাগিল

উঠে সেদিকেই ত্রিপুর সেনা যমের ন্যায় তাহার শিয়রে দণ্ডায়মান। এ অবস্থায় আর যুদ্ধ কি হইবে? গড় দখল হইয়া গেল, মমারক খাঁ বন্দী হইলেন।

 চট্টল অধিকার হইয়া গেলে পাঠানশিবিরের ধনরত্ন মহারাজের ভেট স্বরূপ সংগৃহীত হইল, তাহার মধ্যে পাঁচশত সোণার কুমড়া ছিল, হাতী ঘোড়ার ত কথাই নাই। বিজয়ী ত্রিপুর সৈন্য সগর্ব্বে রাজধানী প্রবেশ করিল। বিজয়মাণিক্য মমারক খাঁকে মুক্তি দিতে চাহিয়াছিলেন কিন্তু ঘটনাচক্রে মমারক খাঁ নিহত হন। পাঠান সেনার পরাজয়ে বিজয়মাণিক্য যেমনি বিজয় তিলক পরিলেন, গৌড়েশ্বর তেমনি মরমে মরিয়া গেলেন। যুদ্ধের সাতদিন পরে গৌড়ের নবাব সুলেমান মহারাজকে চিঠি দিলেন, “ভাই, বিরোধ ভুলিয়া যাও—তুমি আমার সখা; পদ্মার ঐপার অবধি যাত্রাপুর প্রভৃতি দেশ তোমাকে ছাড়িয়া দিয়া উভয় রাজ্যের সীমানা নির্দ্ধারণ করিব। মমারক খাঁকে মুক্তি দাও ইহা আমার সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ।”

 ত্রিপুরেশ্বর সোণার পাতে মুড়াইয়া নবাবের পত্রোত্তর পাঠাইলেন, মমারক জীবিত নাই, এজন্য প্রত্যর্পণ করিতে না পারায় বড়ই দুঃখিত।