পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\۹ \\ রবীন্দ্র-রচনাবলী আপনি অবশ্যই আমার অপেক্ষা অনেক অল্প জানেন- অথচ আপনি পরামর্শ দিতে আসিয়াছেন, আপনার এ-সকল কথা আমি গ্রাহ্য করিতে পারি না ।” তখন বসন্ত রায় উঠিয়া প্রতাপাদিত্যের কাছে আসিয়া প্রতাপাদিত্যের হাত ধরিয়া কহিলেন, “বাবা প্ৰতাপ, মনে কি নাই ! তোকে যে আমি ছেলেবেলায় কোলে পিঠে করিয়া মানুষ করিলাম, সে কি আর মনে পড়ে না ? স্বগীয় দাদা যেদিন তোকে আমার হাতে সমর্পণ করিয়া গিয়াছেন, সেদিন হইতে আমি কি এক মুহুর্তের জন্য তোকে কষ্ট দিয়াছি ? অসহায় অবস্থায় যখন তুই আমার হাতে ছিলি একদিনও কি তুই আপনাকে পিতৃহীন বলিয়া মনে করিতে পারিয়াছিলি ? প্রতাপ, বল দেখি, আমি তোর কী অপরাধ করিয়াছিলাম যাহাতে আমার এই বৃদ্ধ বয়সে তুই আমাকে এত কষ্ট দিতে পারিলি ? এমন কথা আমি বলি না যে, তােকে পালন করিয়াছিলাম বলিয়া তুই আমার কাছে ঋণী— তোদের মানুষ করিয়া আমিই আমার দাদার স্নেহ-ঋণ শোধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম । অতএব প্ৰতাপ, আমি প্রাপা বুলিয়াড়ের কাছে কিছুই চাহি না, কখনাে চাৰিও নাই, আমি কেবল তাের কাছে ভিক্ষ চাহিতেছি— ऊ७3 प्रिादि व्षों ?" বসন্ত রায়ের চােখে জল পড়িতে লাগিল, প্রতাপাদিত্য পাষাণমূর্তির ন্যায় বসিয়া রহিলেন । বসন্ত রায় আবার কহিলেন, “তবে আমার কথা শুনিবি না, আমার ভিক্ষা রাখিবি না ? কথার উত্তর দিবি নে প্ৰতাপ ?” দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “ভালো, আমার আর-একটি ক্ষুদ্র প্রার্থনা আছে, একবার আমি উদয়কে দেখিতে চাই । আমাকে তাহার সেই কারাগৃহে প্রবেশ করিতে কেহ যেন নিযেধ না করে— এই অনুমতি দাও ।” প্রতাপাদিত্য তাহাও দিলেন না । তাহার বিরুদ্ধে উদয়াদিত্যের প্রতি এতখানি স্নেহ প্ৰকাশ করাতে অপরাধী করিয়া তুলিতেছে, ততই তিনি আরো বাকিয়া দাঁড়ান। বসন্ত রায় নিতান্ত স্নানমুখে অন্তঃপুরে ফিরিয়া গেলেন, তাহার মুখ দেখিয়া বিভার অত্যন্ত কষ্ট হইল । বিভা দাদামহাশয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “দাদামহাশয়, আমার ঘরে এসো ।” বসন্ত রায় নীরবে: বিভার সঙ্গে সঙ্গে বিভার ঘরে প্রবেশ করিলেন । তিনি ঘরে বসিলে পর বিভা তাহার কোমল অঙ্গুলি দিয়া তাহার পাকা চুলগুলি নাড়িয়া দিয়া কহিল, “দাদামহাশয়, এসো, তােমার পাকা চুল তুলিয়া দিই৷ ” বসন্ত রায় কহিলেন, “দিদি, সে পাকা চুল কি আর আছে ? যখন বয়স হয় নাই তখন সে-সব ছিল, তখন তোদের পাকা চুল তুলিতে বলিতাম । আজ আমি বুড়া হইয়া গিয়াছি, আজ আর আমার পাকা চুল নাই ।” বসন্ত রায় দেখিলেন বিভার মুখখানি মলিন হইয়া আসিল, তাহার চােখ ছলছল করিয়া আসিল । অমনি তাড়াতাড়ি কহিলেন, “আয় বিভা আয়, গোটাকতক চুল তুলিয়া দে । তোদের পাকা চুল সরবরাহ করিয়া উঠিতে আর তো আমি পারি না ভাই । বয়স হইতে চলিল, ক্রমেই মাথায় টাক পড়িতে চলিল। এখন আর-একটা মাথার অনুসন্ধান করু, আমি জবাব দিলাম।” বলিয়া বসন্ত রায় হাসিতে লাগিলেন । একজন দাসী আসিয়া বসন্ত রায়কে কহিল, “রানীমা আপনাকে একবার প্রণাম করিতে চান ৷” বসন্ত রায় মহিষীর ঘরে গেলেন, বিভা কারাগারে গেল । মহিষী বসন্ত রায়কে প্ৰণাম করিলেন । বসন্ত রায় আশীর্বাদ করিলেন, “মা, আয়ুষ্মতী হও ।” মহিষী কহিলেন, “কাক মহাশয়, ও আশীর্বােদ আর করিবেন না। এখন আমার মরণ হইলেই আমি दै ि।” বসন্ত রায় ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “রাম রাম ! ও কথা মুখে আনিতে নাই ।” বসন্ত রায় অধিকতর ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন । মহিষী কহিলেন, “বিভার মুখখানি দেখিয়া আমার মুখে আর অন্নজল রুচে না । তাহাকে জিজ্ঞাসা