এই মনে করিয়া, ঐ সকল বড়-বড় কালো-চোখের কুতুহলী দৃষ্টি আমাদের উপর নিপতিত।
মধ্যে মধ্যে, একরকম চমৎকার পাখী—“মাছরাঙা”,—খুব উজ্জ্বল, খুব নীলবর্ণ, একপ্রকার আনন্দের চীৎকার করিতে করিতে জলের গা ঘেঁসিয়া উড়িয়া যাইতেছে। নীলপদ্ম ও রক্তপদ্ম চারিদিকে ফুটিয়া আছে।
আমাদের যাত্রাপথের এই অফুরন্ত জলরাশি, বিশেষ বিশেষ সময়ে, বিশেষ বিশেষ ভাব ধারণ করিতেছে:—কখন সঙ্কীর্ণ ও ছায়াময়;—মাথার উপর, দুই ধারের নারিকেলগাছগুলা সম্মিলিত হইয়া মন্দিরমণ্ডপে পরিণত হইয়াছে; শাখাগুলি যেন তাহার খিলান!—তাহার পর, এই জলরাশি ক্রমশঃ বিস্তৃত হইয়া, উচ্ছলিত হইয়া, সুদূর প্রদেশ পর্য্যন্ত প্লাবিত করিতেছে। দুইধারে, যবনিকার ন্যায় নিবিড় তালপুঞ্জ;—তাহার মধ্যে, এই বিলটি উদ্ভিজ্জশ্যামল ক্ষুদ্রদ্বীপসঙ্কুল সাগরবৎ প্রতীয়মান হইতেছে।
সূর্য্য ক্রমশঃ উর্দ্ধে উঠিল। এই ছায়াসত্ত্বেও, এই আলোড়িত জলরাশিসত্ত্বেও, গ্রীষ্মদেশসুলভ উত্তাপ ক্রমশঃ যেন ঘনাইয়া উঠিতেছে। তথাপি, আমাদের দ্রুতগতির কিছুমাত্র লাঘব নাই; আমাদের দাঁড়ীরা সমান জোরে দাঁড় ফেলিতেছে। মাঝি মধ্যে মধ্যে হাঁকডাক্ দিয়া দাঁড়ীদিগকে উত্তেজিত করিতেছে; সেই হাঁকডাকে তাহাদের সমস্ত মাংসপেশী একএক চাবুকের ঘায়ে যেন খাড়া হইয়া উঠিতেছে; এবং তাহারাও তাহার প্রত্যুত্তরে বানরের ন্যায় তীব্রস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিতেছে। আমাদের নৌকার পার্শ্ব দিয়া—তৃণরাশি, পদ্মের বৃন্তসমূহ, বিকশিত খাগড়াগুচ্ছ, আমাদেরি ন্যায় দ্রুতভাবে চলিয়াছে।
বেলা দশটা। এখন আমার নৌকা আর তাল-নারিকেলের নীচে দিয়া যাইতেছে না,—একটা গলির মত সঙ্কীর্ণ পথে, একপ্রকার শাদা ফুলের ঝোপ্ঝাড়ের মধ্য দিয়া চলিয়াছে। আমার সম্মুখে,—দুইধারে সমান সারিসারি তাম্রমূর্ত্তি-মানবেরা যন্ত্রের ন্যায় অঙ্গচালনা করিতেছে।