ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/অজ্ঞাত বন্ধুদের উদ্দেশে

উইকিসংকলন থেকে
অজ্ঞাত বন্ধুদের উদ্দেশে।

 আমাকে শপথ করিতে বলায়, আমি সহজ ভাবের একটি শপথ আবৃত্তি করিলাম; তাহার পর, সেই নিস্তব্ধ ক্ষুদ্র গৃহের তত্ত্বজ্ঞানীরা আমাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করিলেন।

 তাঁহারা আমাকে যে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তাহা পুনরাবৃত্তি করিতে আমি চেষ্টা করিব না।

 প্রথমতঃ, সূক্ষ্ম জগৎ আমার ভ্রমণ-পথের বাহিরে—এইরূপ লোকের মনে হইতে পারে; অতএব, আমার সহিত সূক্ষ্মজগতে বিচরণ করিতে কেহ সম্মত হইবে,—ইহা কি আমি ভরসা করিতে পারি? আমি জানি, লোকে কেবল আমার ভ্রমণপথের মায়া-দৃশ্য—যে অসংখ্য পদার্থের উপর আমি চোখ্‌ বুলাইয়া গিয়াছি, কেবল সেই সব পদার্থের ছায়া-চিত্রই আমার নিকট হইতে প্রত্যাশা করে।

 বিশেষতঃ, আমার এই অল্পদিনের শিক্ষাদীক্ষার পর, আমি অন্যকে শিক্ষা দিতে পারিব এ কথা আমি কি করিয়া বিশ্বাস করি? আমি এখন যাহা বলিতে পারিব তাহাতে শুধু অন্যের চিত্তস্থৈর্য্য নাশ হইবে—হয়ত তাহা কাহাকে “দ্বারদেশের বিভীষিকা’’ পর্য্যন্ত লইয়া যাইবে—তাহার ওদিকে আর নহে।

 তাছাড়া, আমি এখনও ভারতকে আবিস্কার করিতে পারি নাই, যেহেতু বেদকে এখনও আবিষ্কার করিতে পারি নাই; একথা সত্য, কয়েক বৎসর হইতে, আমাদের মধ্যে,—অসম্পূর্ণ হইলেও—ঐ অলৌকিক গ্রন্থের অনুবাদ প্রচারিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে।

 বর্তমান শতাব্দিতে যাঁহাদের সংখ্যা অসংখ্য, আমার সেই সব অজ্ঞাত বন্ধুদের প্রতি আমি শুধু এই কথা বলিতে চাহি;—এই বৈদিক মতের মধ্যে কতটা সান্ত্বনা আছে, তা প্রথম দৃষ্টিতে সহসা উপলব্ধি হয় না।

 এবং উহাতে যে সান্ত্বনা পাওয়া যায়; তাহা ঈশ্বর-প্রকাশিত ধর্ম্মাদির সান্ত্বনার ন্যায়, যুক্তির দ্বারা বিনষ্ট হইবার নহে।

 এই বেদগ্রন্থ একজনের প্রণীত নহে—ইহা একটি সমস্ত জাতির সঙ্কলিত গ্রন্থ; সর্ব্বোৎকৃষ্ট ও পরমাশ্চর্য্য বিষয়সমূহের পাশাপাশি, ইহার মধ্যে, অনেক অস্পষ্টতা, অসঙ্গতি ও ‘ছেলেম’ কথাও আছে; এই গ্রন্থগুলি অরণ্যের ন্যায় নিবীড় ও রসাতলের ন্যায় অতলস্পর্শ। যাঁহারা নির্জ্জনে বসিয়া অবিচলিতচিত্তে এই গ্রন্থগুলির অনুশীলন করেন, সেই বারাণসীর তত্ত্বজ্ঞানীদের সাহায্যেই বোধ হয় উহার মধ্যে আমরা একটু প্রবেশ লাভ করিতে পারি। তাঁহাদের পূর্ব্বে, এই অতলস্পর্শের দ্বার আর কেহ উদ্‌ঘাটিত করে নাই; এই সব কথা আমি আর কোথাও শুনি নাই; জীবন ও মৃত্যুর রহস্য সম্বন্ধে, বারাণসীর তত্ত্বজ্ঞানীরা যে উত্তর প্রদান করেন, তাহাতে মানব-জ্ঞানের আকুল জিজ্ঞাসাকেও পরিতৃপ্ত করিতে পারে; এবং পার্থিব অংশ ধ্বংস হইবার পরেও, তোমার নিজ সত্তা প্রায় চিরস্থায়ী হইবে, এই বিষয় সম্বন্ধে এরূপ প্রমাণ সকল তোমার সম্মুখে তাঁহারা স্থাপন করেন যে, সে বিষয়ে তোমার আর কোন সন্দেহ থাকে না।

 যাই হোক্‌, গোলাপ-উদ্যানে অবস্থিত এই ক্ষুদ্র ধবল গৃহটি, অবারিতদ্বার ও আতিথেয় হইলেও, লঘুহৃদয়ে উহার মধ্যে প্রবেশ করা যায় না। কারণ উহা, প্রধানত সন্ন্যাস ও মৃত্যুর আশ্রম; সেখানকার শান্তির হাওয়া একবার যদি কাহার গায়ে লাগে—যতই অল্প হোক্‌ না কেন—সে আর সে লোক থাকে না। সেই পূর্ণব্রহ্ম যিনি ‘গুহায়িতং’ ‘গহ্বরেষ্ঠং’; সেই ঈশ্বর—এই অভিব্যক্ত বিশ্বের সহিত যাঁহার কোন সম্বন্ধ নাই; সেই ব্রহ্ম যিনি স্বরূপতঃ অনির্ব্বচনীয়, যিনি চিন্তার অতীত, যাঁহার সম্বন্ধে কিছুই বলা যায় না, এবং যাঁহাকে নিস্তব্ধতাই শুধু প্রকাশ করিতে পারে, তাঁহার একটু দর্শন লাভ করা—ইহা একটা ভীষণ পরীক্ষা।