বিষয়বস্তুতে চলুন

গ্রাম্য উপাখ্যান/শুকদেব বসু

উইকিসংকলন থেকে

শুকদেব বসু।

 বাদল গ্রামের দেওয়ান ঘোষ বংশ ও জমিদার ঘোষ বংশের পর মাঝের পাড়ার বসু বংশ গণনীয়। এই বসু বংশের আদি পুরুষ শুকদেব বসু। ইংরাজেরা দিল্লীর বাদশাহের নিকট হইতে কলিকাতার যে দান পত্র প্রাপ্ত হয়েন তাহাতে লিখিত থাকে যে তাহাদিগকে কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটী গ্রাম প্রদত্ত হইল। এই তিনটা গ্রাম লইয়া বর্ত্তমান কলিকাতা সংরচিত। তৃতীয় উইলিয়ম রাজার রাজত্বকালে ১৬৯৮ অব্দে কলিকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা ঐ গোবিন্দপুর গ্রামে নির্ম্মিত হয়। সেই অবধি ঐ গ্রামের নাম গড় গোবিন্দপুর হয়। ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ নির্ম্মাণ জন্য যে যে লোকের জমি লওয়া হয় তাহাদিগকে সেই সেই জমির পরিবর্ত্তে ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট সুতানুটি ও খাস কলিকাতায় জমি দেন। পূর্ব্বে মহারাষ্ট্রীয় খাত (Moharatha Ditch) এবং পশ্চিমে জগন্নাথের ঘাট ইহার মধ্যস্থিত বৃহদায়তন ভূমিখণ্ডের নাম সুতানুটি ছিল। দুর্গ নির্ম্মাণ জন্য যাঁহারা গোবিন্দপুর হইতে তাড়িত হয়েন তাঁহাদিগের মধ্যে গোবিন্দপুরের বসু বংশীয় লোকেরা ছিলেন। ইহাঁরা নিজ নিজ পৈতৃক জমির পরিবর্ত্তে কলিকাতার এথেন্স (Athens) সিমুলিয়া, দারমাহাটা ও বাগবাজারে জমি প্রাপ্ত হয়েন। কলিকাতার সিমলা অঞ্চলে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোর গির্জ্জা, ডফ্‌সাহেবের স্কুল,”ও “ভারতবর্ষীয় কবি” উপাধিধারী কাশী প্রসাদ ঘোষের বাটী থাকাতে পূর্ব্বে কোন কোন বিদ্বান্ ব্যক্তি ঐ স্থানকে কলিকাতার এথেন্স বলিয়া ডাকিতেন। এক্ষণে পটলডাঙ্গা ঐ নামের উপযুক্ত। সে কালে সিমুলিয়াবাসী বসুদিগের মধ্যে প্রাণকৃষ্ণ বসু, দরমাহাটার বসুদিগের মধ্যে নয়ানচন্দ্র বসু, এবং বাগবাজারের বসুদিগের মধ্যে কাশীনাথ বসু প্রধান ছিলেন। নয়ানচন্দ্র বসু তাঁহার বৃহৎ অট্টালিকা জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কাশীনাথ বসু সেকালের একজন বিখ্যাত গ্রন্থকর্ত্তা ছিলেন। তিনি অন্যান্য গ্রন্থ মধ্যে “বিজ্ঞান কুসুমাকর” নামক বহুল সংস্কৃত শ্লোকপূর্ণ একটি পুস্তক প্রকাশ করিয়াছিলেন। তিনি যে যে গ্রন্থ প্রকাশ কবিয়াছিলেন তাহার প্রথমে একটী করিয়া গণেশদেবের ছবি থাকিত। ইনি গাণপত্য ছিলেন। শুকদেব বসু সিমুলিয়া নিবাসী প্রাণকৃষ্ণ বসু প্রমুখ বসুদিগের মধ্যে একজন। তিনি বাদল গ্রামে বিবাহ করিয়া তথায় বসতি করেন। কথিত আছে শুকদেব বসু পাণ্ডু রোগাক্রান্ত হইয়া বৈদ্যনাথে হত্যা দিবার জন্য তথায় যাত্রা করেন। আমরা পূর্ব্বে বাদল গ্রামের যে ভৌগলিক বিবরণ দিয়াছি তন্মধ্যে দিঘির আড়ার সংস্থিত ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর মঠের কথার উল্লেখ আছে। বৈদ্যনাথ স্বপ্ন দিলেন যে তোমার আর বৈদ্যনাথ পর্য্যন্ত যাইবার আবশ্যক নাই। প্রাতঃকালে ত্রিপুরাসুন্দরীর মঠের সুরকি ও রাত্রিতে শয়নের পূর্ব্বে তাহার চূর্ণ প্রত্যহ কিছুদিন খাইলে তুমি আরোগ্য লাভ করিবে। কি অনুপানের সহিত ঐ চুণ ও সুরকি সেবন করিতে হইবে তাহাও বৈদ্যনাথ বলিয়াছিলেন। বিজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন যে পাণ্ডুরোগে পুরাতন চূণ ও সুরকি সেবন উপকার প্রদান করে। স্বপ্নে যে আমরা কোন কোন আবিস্ক্রিয়া কিম্বা প্রতিভাসূচক কার্য্য করিতে সক্ষম হই ইহা প্রসিদ্ধ কথা। কবিবর কোলরিজ (Coleridge) স্বপ্নে “কবলে খা” শিরস্ক কল্পনাশক্তির পরাকাষ্ঠা-সূচক কবিতা রচনা করেন। ইটালী দেশীয় সুবিখ্যাত বেহালাওয়ালা টার্টিনি (Tartini) শয়তানী সুর নামক বিখ্যাত সুর নিদ্রার সময় আবিষ্ক্রিয়া করেন। তিনি স্বপ্ন দেখিলেন যে ছাগলের ন্যায় চেরা পা ও শিংবিশিষ্ট শয়তান (ইংরাজীওয়ালা পাঠকবর্গ অবশ্যই অবগত আছেন যে উক্ত ভদ্রলোকটী ঐ সকল শারীরিক লক্ষণ বিশিষ্ট; আমাদের একটা পাদ্রী বন্ধু বলেন যে তাঁহার সুদীর্ঘ “মোচ” ও “গোঁফ” ও আছে) আসিয়া তাঁহার বেহালা পাড়িয়া তাহাতে এমন এক সুর বাজাইতে লাগিলেন যে তিনি একেবারে মোহিত হইয়া গেলেন। টার্টিনি তৎক্ষণাৎ জাগিয়া নিজের যথার্থ বেহালা পাড়িয়া সেই সুর বাজাইয়া তাহা আয়ত্ত করিলেন। তাহার পর যাহার যাহার নিকট ঐ সুর বাজাইয়া ছিলেন তাহারা তাহার মধুরতায় বিগলিত হইয়া কিয়ৎক্ষণের জন্য উন্মত্ত প্রায় হইয়াছিল। গরীব যে আমরা আমরাও স্বপ্নে একবার একটী অতি উৎকৃষ্ট উপমা প্রাপ্ত হই। গ্রীষ্মকালে শুষ্ক ফল্গু নদীর উত্তপ্ত বালুকা কিঞ্চিৎ খনন করিলে দেখা যায় যে তাহার অব্যবহিত নিম্নে শীতল জলের প্রবাহ প্রবাহিত হইতেছে, সেইরূপ সংসারের দুঃখ কষ্টের অব্যবহিত নিম্নেই ঈশ্বরের মঙ্গলাভিপ্রায়রূপ সুশীতল প্রবাহ প্রবাহিত হইতেছে, আমরা এই ভাবটী স্বপ্নে প্রাপ্ত হই। আমাদিগের কোন বন্ধু যিনি এক্ষণে বঙ্গদেশের পুরাতত্ত্বানুসন্ধায়ীদিগের মধ্যে প্রধান আসন অধিকার করেন। তিনি আমাদিগকে বলিয়াছিলেন যে তাঁহার বাটীর মূর্চ্ছা (Hysterea) রোগগ্রস্ত কোন স্ত্রীলোক স্বপ্নে সেই রোগের ঔষধ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি ঘোর দ্বিপ্রহর রাত্রে মূর্চ্ছা সময়ে অকস্মাৎ উঠিয়া একতলার একটা অন্ধকার ঘরে গমন করিয়া তাহার অপলস্তরা দেওয়ালের দুই ইটের মধ্যে সংস্থিত একটী দ্রব্য আনিয়া ভক্ষণ করাতে সেই রোগ হইতে একেবারে বিমুক্তি লাভ করেন। আমরা যে নিদ্রার সময় কোন কোন পরম সত্য লাভ করিতে সক্ষম হই ইহার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। কিন্তু কি প্রকারে যে ঐ প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় তাহা এপর্য্যন্ত বিজ্ঞানবিৎ পণ্ডিতেরা স্থির করিতে সক্ষম হয়েন নাই। প্রকৃতিদেবী বড় সুরসিকা। বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতেরা হাজার তাঁহার অনুসরণ করুন তাঁহারা পরিশেষে যেখানে গিয়া থামেন দেখেন দেবী তাঁহাদিগের অনেক এগিয়ে গিয়া বসিয়া আছেন। তিনি কোন মতে ধরা দেন না। শুকদেব বসু উপরি-উক্ত ঔষধ দ্বারা নিজে আরোগ্য লাভ করিয়া অন্য অনেক লোককে তদ্দ্বারা আরোগ্য করাতে ঔষধের যশ চতুর্দ্দিকে ব্যাপ্ত হইল। দেশ দেশান্তর হইতে লোক আসিয়া ঔষুধ লইয়া যাইতে লাগিল। বৈদ্যনাথ স্বপ্ন দিয়াছিলেন যে শুকদেব বসুর বংশের লোক ব্যতীত অন্য লোকে ঐ ঔষধ হাতে করিয়া দিলে তাহার ফল ফলিবে না। কিন্তু শুকদেব বসুর প্রপৌত্র ভূতপূর্ব্ব হিন্দু কলেজের ছাত্র রামনারায়ণ বাবু যখন মেলেরিয়া জন্য গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া আসিতে বাধ্য হয়েন তখন ঔষধ বিতরণ করিবার ভার গ্রামের বাঙ্গালাস্কুলের পণ্ডিত মহাশয়ের প্রতি অর্পণ করিয়া আইসেন। তাঁহার হাতে উক্ত ঔষধ ফলশূন্য হয় নাই। কেনই বা হইবে?