বিষয়বস্তুতে চলুন

চাঁদের পাহাড়/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


আট

 মাঝ-রাত্রে শঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল। কি একটা শব্দ হচ্ছে ঘন বনের মধ্যে, কি একটা কাণ্ড কোথায় ঘট্‌চে বনে। আলভারেজও বিছানায় উঠে বসেচে। দু’জনেই কান-খাড়া করে শুনলে—বড় অদ্ভুত ব্যাপার! কি হচ্ছে বাইরে?

 শঙ্কর তাড়াতাড়ি টর্চ্চ জ্বেলে বাইরে আসছিল, আলভারেজ বারণ করলে। বল্লে—এসব অজানা জঙ্গলে রাত্রিবেলা ও রকম তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে যেও না। তোমাকে অনেকবার সতর্ক করে দিয়েচি। বিনা বন্দুকেই বা যাচ্চ কোথায়?

 তাঁবুর বাইরে রাত্রি ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু’জনেই টর্চ্চ ফেলে দেখলে—

 বন্য-জন্তুর দল গাছ-পালা ভেঙ্গে ঊর্দ্ধশ্বাসে উন্মত্তের মত দিকবিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পশ্চিমের সেই ভীষণ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে, পুবদিকের পাহাড়টার দিকে চলেচে! হায়েনা, বেবুন, বুনো মহিষ। দুটো চিতাবাঘ তো ওদের গা ঘেঁষে ছুটে পালালো। আরও আসচে… দলে দলে আসচে… ধাড়ী ও মাদী কলোবাস বাঁদর দলে দলে ছানাপোনা নিয়ে ছুটেচে। সবাই যেন কোনো আকস্মিক বিপদের মুখ থেকে প্রাণের ভয়ে ছুটচে! আর সঙ্গে সঙ্গে দূরে কোথায় একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে— চাপা, গম্ভীর, মেঘগর্জ্জনের মতো শব্দটা, কিংবা দূরে কোথাও হাজারটা জয়ঢাক যেন এক সঙ্গে বাজ্‌চে!

 ব্যাপার কী! দু’জনে দু’জনের মুখের দিকে চাইলে। দু’জনেই অবাক্। আলভারেজ বল্লে—শঙ্কর, আগুনটা ভালো করে জ্বালো—নয়তো বন্যজন্তুর দল আমাদের তাঁবুসুদ্ধ ভেঙে মাড়িয়ে চলে যাবে।

 জন্তুদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলল যে! মাথার ওপরেও পাখির দল বাসা ছেড়ে পালাচ্চে। প্রকাণ্ড একটা স্প্রিংবক্ হরিণের দল ওদের দশ গজের মধ্যে এসে পড়ল।

 কিন্তু ওরা দু’জনে তখন এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েচে ব্যাপার দেখে যে, এত কাছে পেয়েও গুলি করতে ভুলে গেল। এমন ধরনের দৃশ্য ওরা জীবনে কখনো দেখেনি!

 শঙ্কর আলভারেজকে কি একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে, তারপরেই—প্রলয় ঘটল। অন্ততঃ শঙ্করের তো তাই বলে মনে হলো। সমস্ত পৃথিবীটা দুলে এমন কেঁপে উঠল যে, ওরা দু’জনেই টলে পড়ে গেল মাটীতে, সঙ্গে সঙ্গে হাজারটা বাজ্ যেন নিকটেই কোথাও পড়ল। মাটী যেন চিরে ফেঁড়ে গেল—আকাশটাও যেন সেই সঙ্গে ফাটলো।

 আলভারেজ মাটী থেকে উঠবার চেষ্টা করতে করতে বল্লে—ভূমিকম্প!

 কিন্তু পরক্ষণেই তারা দেখে বিস্মিত হোল, রাত্রির অমন ঘুট্‌ঘুটে অন্ধকার হঠাৎ দূর হয়ে, পঞ্চাশহাজার বাতির এমন বিজ্‌লি আলো জ্বলে উঠল কোথা থেকে?

 তারপর তাদের নজরে পড়ল, দূরের সেই পাহাড়ের চূড়াটার দিকে। সেখানে যেন একটা প্রকাণ্ড অগ্নিলীলা সুরু হয়েচে। রাঙা হয়ে উঠেচে সমস্ত দিগন্ত সেই প্রলয়ের আলোয়, আগুন-রাঙা মেঘ ফুঁসিয়ে উঠেচে পাহাড়ের চূড়ো থেকে দু’হাজার, আড়াই হাজার ফুট পর্য্যন্ত উঁচুতে—সঙ্গে সঙ্গে কি বিশ্রী নিঃশ্বাস রোধকারী গন্ধকের উত্‍কট গন্ধ বাতাসে!

 আলভারেজ সেদিকে চেয়ে ভয়ে বিস্ময়ে বলে উঠল—আগ্নেয়গিরি! সাণ্টা আনা গ্রাৎ‌সিয়া ডা কর্ডোভা!

 কি অদ্ভুত ধরনের ভীষণ সুন্দর দৃশ্য! কেউ চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলে না ওরা খানিকক্ষণ। লক্ষটা তুবড়ি এক সঙ্গে জ্বলচে, লক্ষটা রঙমশালে যেন এক সঙ্গে আগুন দিয়েছে, শঙ্করের মনে হল। রাঙা আগুনের মেঘ মাঝে মাঝে নীচু হয়ে যায়, হঠাৎ যেমন আগুনে ধুনো পড়লে দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে, অমনি দপ্‌ করে হাজার ফুট ঠেলে ওঠে। আর সেই সঙ্গে হাজারটা বোমাফাটার আওয়াজ।

 এদিকে পৃথিবী এমন কাঁপচে যে, দাঁড়িয়ে থাকা যায় না—কেবল টলে টলে পড়তে হয়। শঙ্কর তো টলতে টলতে তাঁবুর মধ্যে ঢুকলো—ঢুকে দেখে একটা ছোট কুকুর ছানার মত জীব তার বিছানায় এক সঙ্গে গুটিসুটি হয়ে ভয়ে কাঁপচে। শঙ্করের টর্চ্চের আলোয় সেটা থতমত খেয়ে আলোর দিকে চেয়ে রইল, আর তার চোখ দুটো মণির মতো জ্বলতে লাগলো। আলভারেজ তাঁবুতে ঢুকে দেখে বল্লে—নেকড়ে বাঘের ছানা। রেখে দাও, আমাদের আশ্রয় নিয়েচে যখন প্রাণের ভয়ে।

 ওরা কেউ এর আগে প্রজ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি দেখেনি, তা থেকে যে বিপদ আসতে পারে তা ওদের জানা নেই—কিন্তু আলভারেজের কথা ভালো করে শেষ হতে না হতে, হঠাৎ কি প্রচণ্ড ভারী জিনিসের পতনের শব্দে ওরা আবার তাঁবুর বাইরে গিয়ে যখন দেখলে যে, একখানা পনেরো সের ওজনের জ্বলন্ত কয়লার মতো রাঙা পাথর অদূরে একটা ঝোপের ওপর এসে পড়েচে — সঙ্গে সঙ্গে ঝোপটাও জ্বলে উঠেচে — তখন আলভারেজ ব্যস্তসমস্ত হয়ে বল্লে—পালাও, পালাও; শঙ্কর, তাঁবু ওঠাও—শীগ্‌গির—

 ওরা তাঁবু ওঠাতে ওঠাতে আরও দু’পাঁচখানা আগুন-রাঙা জ্বলন্ত ভারী পাথর এদিক ওদিক সশব্দে পড়লো। নিঃশ্বাস তো এদিকে বন্ধ হয়ে আসে, এমনি ঘন গন্ধকের ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়েচে।

 দৌড়…দৌড়…দৌড়…দু’ঘণ্টা ধরে ওরা জিনিসপত্র কতক টেনে হিঁচড়ে, কতক বয়ে নিয়ে পূবদিকের সেই পাহাড়ের নীচে গিয়ে পৌঁছুলো। সেখানে পর্য্যন্ত গন্ধকের গন্ধ বাতাসে। আধঘণ্টা পরে সেখানেও পাথর পড়তে সুরু করলে। ওরা পাহাড়ের উপর উঠ্‌ল, সেই ভীষণ জঙ্গল আর রাত্রির অন্ধকার ঠেলে। ভোর যখন হোল, তখন আড়াই হাজার ফুট উঠে পাহাড়ের ঢালুতে বড় একটা গাছের তলায়, দু’জনেই হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়লো।

 সূর্য্য ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে অগ্ন্যুৎপাতের সে ভীষণ সৌন্দর্য্য অনেকখানি কমে গেল, কিন্তু শব্দ ও পাথর পড়া যেন বাড়লো। এবার শুধু পাথর নয়, তার সঙ্গে খুব মিহি ধূসরবর্ণের ছাই আকাশ থেকে পড়চে…গাছপালা লতাপাতার ওপর দেখতে দেখতে পাৎলা একপুরু ছাই জমে গেল।

 সারাদিন সমানভাবে অগ্নিলীলা চললো—আবার রাত্রি এল। নিম্নের উপত্যকা ভূমির অত বড় হেমলক্ গাছের জঙ্গল দাবানলে ও প্রস্তর বর্ষণে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল। রাত্রিতে আবার সেই ভীষণ সৌন্দর্য্য, কতদূর পর্য্যন্ত বন ও আকাশ, কতদূরের দিগন্ত লাল হয়ে উঠেচে পর্ব্বতের অগ্নিকটাহের আগুনে—তখন পাথর পড়াটা একটু কেবল কমেচে। কিন্তু সেই রাঙা আগুনভরা বাষ্পের মেঘ তখনো সেই রকমই দীপ্ত হয়ে উঠেচে।

 রাত দুপুরের পরে একটা বিরাট বিস্ফোরনের শব্দে ওদের তন্দ্রা ছুটে গেল—ওরা সভয়ে চেয়ে দেখলে জ্বলন্ত পাহাড়ের চূড়ার মুণ্ডটা উড়ে গিয়েচে—নীচের উপত্যকাতে ছাই, আগুন ও জ্বলন্ত পাথর ছড়িয়ে পড়ে অবশিষ্ট জঙ্গলটাকেও ঢাকা দিলে। আল্‌ভারেজ পাথরের ঘায়ে আহত হোল। ওদের তাঁবুর কাপড়ে আগুন ধরে গেল। পেছনের একটা উঁচু গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল পাথরের চোট খেয়ে।

 শঙ্কর ভাবছিল—এই জনহীন আরণ্য অঞ্চলে এত বড় একটা প্রাকৃতিক বিপর্য্যয় যে ঘটে গেল, তা কেউ দেখতেও পেতো না, যদি তারা না থাকতো। সভ্য জগৎ জানেও না, আফ্রিকার গহন অরণ্যের এ আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব। কেউ বল্লেও বিশ্বাস করবে না হয়তো।

 সকালে বেশ স্পষ্ট দেখা গেল, মোমবাতি হাওয়ার মুখে জ্বলে গিয়ে যেমন মাথার দিকে অসমান খাঁজের সৃষ্টি করে, পাহাড়ের চূড়াটার তেমনি চেহারা হয়েচে। কুল্পী বরফটাতে ঠিক যেন কে আর একটা কামড় বসিয়েচে।

 আল্‌ভারেজ ম্যাপ দেখে বল্লে—এটা আগ্নেয়গিরি বলে ম্যাপে দেওয়া নেই। সম্ভবতঃ বহু বৎসর পরে এই এর প্রথম অগ্ন্যুৎপাত। কিন্তু এর যে নাম ম্যাপে দেওয়া আছে, তা খুব অর্থপূর্ণ।

 শঙ্কর বল্লে—কি নাম?

 আলভারেজ বল্লে—এর নাম লেখা আছে ‘ওল্‌ডোনিও লেঙ্গাই’—প্রাচীন জুলু ভাষায় এর মানে ‘অগ্নিদেবের শয্যা’। নামটা দেখে মনে হয়, এ অঞ্চলের প্রাচীন লোকদের কাছে এ পাহাড়ের আগ্নেয় প্রকৃতি অজ্ঞাত ছিল না। বোধহয় তারপর দু’একশো বছর কিংবা তারও বেশীকাল এটা চুপচাপ ছিল।

 ভারতবর্ষের ছেলে শঙ্করের দুই হাত আপনা আপনি প্রণামের ভঙ্গিতে ললাট স্পর্শ করলে। প্রণাম, হে রুদ্রদেব, প্রণাম। আপনার তাণ্ডব দেখবার সুযোগ দিয়েচেন, এজন্যে প্রণাম গ্রহণ করুন, হে দেবতা। আপনার এ রূপের কাছে শত হীরকখনি তুচ্ছ হয়ে যায়, আমার সমস্ত কষ্ট সার্থক হোল।