বিষয়বস্তুতে চলুন

চাঁদের পাহাড়/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


সাত

তারপর দিন দুই কেটে গেল। ওরা ক্রমশঃ গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলে। পথ কোথাও সমতল নয়, কেবল চড়াই আর উৎরাই, মাঝে মাঝে কর্কশ ও দীর্ঘ টুসক ঘাসের বন, জল প্রায় দুষ্প্রাপ্য, ঝরণা এক আধটা যদিও বা দেখা যায়, আলভারেজ তাদের জল ছুঁতেও দেয় না। দিব্যি স্ফটিকের মত নির্ম্মল জল পড়চে ঝরণা বেয়ে, সুশীতল ও লোভনীয়, তৃষ্ণার্ত্ত লোকের পক্ষে সে লোভ সম্বরণ করা বড়ই কঠিন - কিন্তু আলভারেজ জলের বদলে ঠাণ্ডা চা খাওয়াবে তবুও জল খেতে দেবে না। জলের তৃষ্ণা ঠাণ্ডা চায়ে দূর হয় না, তৃষ্ণার কষ্টই সব চেয়ে বেশী কষ্ট বলে মনে হচ্ছিল শঙ্করের। একস্থানে টুসক ঘাসের বন বেজায় ঘন। তার ওপরে চারিধার ঘিরে সেদিন কুয়াসাও খুব গভীর। হঠাৎ বেলা উঠলে নীচের কুয়াসা সরে গেল - সামনে চেয়ে শঙ্করের মনে হোল, খুব বড় একটা চড়াই তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে, কত উঁচু সেটা তা জানা সম্ভব নয়, কারণ নিবিড় কুয়াসা কিংবা মেঘে তার ওপরের দিকটা সম্পূর্ণরূপে আবৃত। আলভারেজ বল্লে - রিখটারসভেল্ডের আসল রেঞ্জ।

শঙ্কর বল্লে - এটা পার হওয়া কি দরকার?

আলভারেজ বল্লে - এইজন্যে দরকার যে সেবার আমি আর জিম দক্ষিণ দিক থেকে এসেছিলুম এই পর্ব্বতশ্রেণীর পাদমূলে কিন্তু আসল রেঞ্জ পার হইনি। যে নদীর ধারে হলদে হীরে পাওয়া গিয়েছিল, তার গতি পূব থেকে পশ্চিমে। এবার আমরা যাচ্ছি উত্তর থেকে দক্ষিণে সুতরাং পর্ব্বত পার হোয়ে ওপারে না গেলে কি করে সেই নদীটার ঠিকানা করতে পারি।

শঙ্কর বল্লে - আজ যে রকম কুয়াসা হয়েছে দেখতে পাচ্চি, তাতে একটু অপেক্ষা করা যাক না কেন? আর একটু বেলা বাড়ুক।

তাঁবু ফেলে আহারাদি সম্পন্ন করা হোল। বেলা বাড়লেও কুয়াসা তেমন কাটল না। শঙ্কর ঘুমিয়ে পড়ল তাঁবুর মধ্যে। ঘুম যখন ভাংল, বেলা তখন নেই। চোখ মুছতে মুছতে তাঁবুর বাইরে এসে সে দেখলে আলভারেজ চিন্তিত-মুখে ম্যাপ খুলে বসে আছে। শঙ্করকে দেখে বল্লে - শঙ্কর, আমাদের এখনও অনেক ভুগতে হবে। সামনে চেয়ে দেখ।

আলভারেজের কথার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে চাইতেই এক গম্ভীর দৃশ্য শঙ্করের চোখে পড়ল। কুয়াসা কখন কেটে গেছে, তার সামনে বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্ব্বতের প্রধান থাক্‌ ধাপে ধাপে উঠে মনে হয় যেন আকাশে গিয়ে ঠেকেচে। পাহাড়ের কটিদেশ নিবিড় বিদ্যুৎগর্ভ মেঘপুঞ্জে আবৃত কিন্তু উচ্চতম শিখররাজি অস্তমান সূর্য্যের রাঙা আলোয় দেবালোকের কনকদেউলের মত বহুদূর নীল শূন্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।

কিন্তু সামনের পর্ব্বতাংশ সম্পূর্ণ দুরারোহ - শুধুই খাড়া খাড়া উত্তুঙ্গ শৃঙ্গ - কোথাও একটু ঢালু নেই। আলভারেজ বল্লে - এখান থেকে পাহাড়ে ওঠা সম্ভব নয়, শঙ্কর। দেখেই বুঝেচ নিশ্চয়। পাহাড়ের কোলে কোলে পশ্চিম দিকে চল। যেখানে ঢালু এবং নীচু পাবো, সেখান দিয়েই পাহাড় পার হতে হবে। কিন্তু এই দেড়শো মাইল লম্বা পর্ব্বতশ্রেণীর মধ্যে কোথায় সে রকম জায়গা আছে, এ খুঁজতেই তো এক মাসের ওপর যাবে দেখচি।

কিন্তু দিন পাঁচ ছয় পশ্চিম দিকে যাওয়ার পরে এমন একটা জায়গা পাওয়া গেল, যেখানে পর্ব্বতের গা বেশ ঢালু, সেখান দিয়ে পর্ব্বতে ওঠা চলতে পারে।

পরদিন খুব সকাল থেকে পর্ব্বতারোহণ শুরু হোল। শঙ্করের ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে ছ'টা। সাড়ে আটটা বাজতে না বাজতে শঙ্কর আর চলতে পারে না। যে যায়গাটা দিয়ে তারা উঠচে - সেখানে পর্ব্বতের খাড়াই চার মাইলের মধ্যে উঠেচে ছ'হাজার ফুট, সুতরাং পথটা ঢালু হোলেও কি ভীষণ দুরারোহ তা সহজেই বোঝা যাবে। তা ছাড়া যতই ওপরে উঠচে, অরণ্য ততই নিবিড়তর, ঘন অন্ধকার চারিদিক, বেলা হয়েচে, রোদ উঠেচে, অথচ সূর্য্যের আলো ঢোকে নি জঙ্গলের মধ্যে - আকাশই চোখে পড়ে না তায় সূর্য্যের আলো।

পথ বলে কোনো জিনিস নেই। চোখের সামনে শুধুই গাছের গুঁড়ি যেন ধাপে ধাপে আকাশের দিকে উঠে চলেচে। কোথা থেকে জল পড়চে কে জানে, পায়ের নীচের প্রস্তর আর্দ্র ও পিচ্ছিল, প্রায় সর্ব্বত্রই পাথরের ওপর শেওলা-ধরা। পা পিছলে গেলে গড়িয়ে নীচের দিকে বহুদূর চলে গিয়ে তীক্ষ্ণ শিলাখণ্ডে আহত হতে হবে।

শঙ্কর বা আলভারেজ কারো মুখে কথা নেই। এই উত্তুঙ্গ পথে উঠ্‌বার কষ্টে দু'জনেই অবসন্ন, দু'জনেরই ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়চে। শঙ্করের কষ্ট আরও বেশী, বাংলার সমতল ভূমিতে আজন্ম মানুষ হয়েচে, পাহাড়ে ওঠার অভ্যাসই নেই কখনো।

শঙ্কর ভাবচে, আলভারেজ কখন বিশ্রাম করতে বলবে? সে আর উঠতে পারচে না, কিন্তু যদিও সে মরেও যায়, একথা আলভারেজকে সে কখনই বলবে না, যে সে আর পারচে না। হয়তো তাতে আলভারেজ ভাববে, ইষ্ট ইণ্ডিজের মানুষগুলো দেখচি নিতান্ত অপদার্থ। এই মহাদুর্গম পর্ব্বত ও অরণ্যে সে ভারতের প্রতিনিধি - এমন কোনো কাজ সে করতে পারে না যাতে তার মাতৃভূমির মুখ ছোট হয়ে যায়।

বড় চমৎকার বন, যেন পরীর রাজ্য, মাঝে মাঝে ছোটখাটো ঝরণা বনের মধ্যে দিয়ে খুব ওপর থেকে নীচে নেমে যাচ্চে। গাছের ডালে ডালে নানা রঙের টিয়াপাখী চোখ ঝলসে দিয়ে উড়ে বেড়াচ্চে। বড় বড় ঘাসের মাথায় শাদা শাদা ফুল, অর্কিডের ফুল ঝুলচে গাছের ডালের গায়ে, গুঁড়ির গায়ে।

হঠাৎ শঙ্করের চোখ পড়ল, গাছের ডালে মাঝে মাঝে লম্বা দাড়ি গোঁপওয়ালা বালখিল্য মুনিদের মত ও কারা বসে রয়েচে। তারা সবাই চুপচাপ বসে, মুনিজনোচিত গাম্ভীর্য্যে ভরা। ব্যাপার কি?

আলভারেজ বল্লে - ও কলোবাস জাতীয় মাদী বানর। পুরুষ জাতীয় কলোবাস বানরের দাড়ী গোঁফ নেই, স্ত্রী জাতীয় কলোবাস বানরের হাতখানেক লম্বা দাড়ী গোঁফ গজায় এবং তারা বড় গম্ভীর, দেখেই বুঝতে পাচ্চ।

ওদের কাণ্ড দেখে শঙ্কর হেসেই খুন।

পায়ের তলায় মাটীও নেই, পাথরও নেই - তাদের বদলে আছে শুধু পচা পাতা ও শুকনো গাছের গুঁড়ির স্তূপ। এই সব বনে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাতার রাশি ঝরচে, পচে যাচ্চে, তার ওপরে শেওলা পুরু হয়ে উঠচে, ছাতা গজাচ্চে, তার ওপরে আবার নতুন-ঝরা পাতার রাশি, আবার পড়চে গাছের ডাল-পালা, গুঁড়ি। জায়গায় জায়গায় ষাট সত্তর গভীর হয়ে জমে রয়েচে এই পত্র স্তূপ।

আলভারেজ ওকে শিখিয়ে দিলে, এ সব জায়গায় খুব সাবধানে পা ফেলে চলতে হবে। এমন জায়গা আছে, যেখানে মানুষে চলতে চলতে ওই ঝরা পাতার রাশির মধ্যে ভুস করে ঢুকে ডুবে যেতে পারে, যেমন অতর্কিতে পথ চলতে চলতে প্রাচীন কূপের মধ্যে পড়ে যায়। উদ্ধার করা সম্ভব না হলে সে সব ক্ষেত্রে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু অনিবার্য্য।

শঙ্কর বল্লে - পথের গাছপালা না কাটলে আর তো ওঠা যাচ্চে না, বড় ঘন হয়ে উঠচে। ক্ষুরের মত ধারাল চওড়া এলিফ্যাণ্ট ঘাসের বন - যেন রোমান যুগের দ্বিধার তলোয়ার। তার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দুজনের কেহই নিরাপদ বলে ভাবচে না নিজেকে, দুহাত তফাতে কি আছে দেখা যায় না যখন, তখন সব রকম বিপদের সম্ভাবনাই তো রয়েচে। থাকতে পারে বাঘ, থাকতে পারে সিংহ, থাকতে পারে বিষাক্ত সাপ।

শঙ্কর লক্ষ্য করচে মাঝে মাঝে ডুগডুগি বা ঢোল বাজনার মত একটা শব্দ হচ্চে কোথায় যেন বনের মধ্যে। কোনো অসভ্য জাতির লোক ঢোল বাজাচ্চে নাকি? আলভারেজকে সে জিগ্যেস করলে।

আলভারেজ বল্লে - ঢোল নয়, বড় বেবুন কিংবা বনমানুষে বুক চাপড়ে ওই রকম শব্দ করে। মানুষ এখানে কোথা থেকে আসবে?

শঙ্কর বল্লে - তুমি যে বলেছিলে এ বনে গরিলা নেই?

- গরিলা সম্ভবতঃ নেই। আফ্রিকার মধ্যে বেলজিয়ান কঙ্গোর কিভু অঞ্চল, রাওয়েনজরী আল্পস বা ভিরুঙ্গা আগ্নেয় পর্ব্বতের অরণ্য ছাড়া অন্য কোথাও গরিলা আছে বলে তো জানা নেই। গরিলা ছাড়াও অন্য ধরণের বনমানুষে বুক চাপড়ে ও রকম আওয়াজ করতে পারে।

ওরা সাড়ে চার হাজার ফুটের ওপর উঠেচে। সেদিনের মত সেখানেই রাত্রির বিশ্রামের জন্য তাঁবু ফেলা হোল। একটা বিশাল সত্যিকার ট্রপিক্যাল অরণ্যের রাত্রিকালীন শব্দ এত বিচিত্র ধরণের ও এত ভীতিজনক যে সারারাত শঙ্কর চোখের পাতা বোজাতে পারলে না। শুধু ভয় নয়, ভয় মিশ্রিত একটা বিস্ময়।

কত রকমের শব্দ - হায়েনার হাসি, কলোবাস বানরের কর্কশ চীৎকার, বনমানুষের বুক চাপড়ানোর আওয়াজ, বাঘের ডাক - প্রকৃতির এই বিরাট নিজস্ব পশুশালায় রাত্রে কেউ ঘুমোয় না। সমস্ত অরণ্যটা এই গভীর রাত্রে যেন হঠাৎ ক্ষেপে উঠেচে। বছর কয়েক আগে খুব বড় একটা সার্কাসের দল এসে ওদের স্কুল-বোর্ডিংয়ের ছেলেরা রাত্রে ঘুমুতে পারতো না - শঙ্করের সেই কথা এখন মনে পড়ল। কিন্তু এ সবের চেয়েও মধ্যরাত্রে একদল বন্য হস্তীর বৃংহতী ধ্বনি তাঁবুর অত্যন্ত নিকটে শুনে শঙ্কর এমন ভয় পেয়ে গেল যে, আলভারেজকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠালে। আলভারেজ বল্লে - আগুন জ্বলছে তাঁবুর বাইরে, কোনো ভয় নেই, ওরা ঘেঁসবে না এদিকে।

সকালে উঠে আবার ওপরে ওঠা সুরু। উঠচে, উঠচে - মাইলের পর মাইল বন্য বাঁশের অরণ্য, তার তলায় বুনো আদা। ওদের পথের একশো হাতের মধ্যে বাঁদিকের বাঁশবনের তলা দিয়ে একটা প্রকাণ্ড হস্তীযূথ কচি বাঁশের কোঁড় মড়্‌মড়্‌ করে ভাঙতে ভাঙতে চলে গেল।

পাঁচ হাজার ফুট ওপরে কত কি বন্য পুষ্পের মেলা টকটকে লাল ইরিথ্রিনা প্রকাণ্ড গাছে ফুটেচে। পুষ্পিত ইপোমিয়া লতার ফুল দেখতে ঠিক বাংলাদেশের বনকমলী ফুলের মত কিন্তু রংটা অত গাঢ় বেগুণী নয়। শাদা ভেরোনিকা ঘন সুগন্ধে বাতাসকে ভারাক্রান্ত করেচে। বন্য কফির ফুল, রঙীন বেগোনিয়া। মেঘের রাজ্যে ফুলের বন, মাঝে মাঝে সাদা বেলুনের মত মেঘপুঞ্জ গাছপালার মগ্‌ডালে এসে আট্‌কাচ্চে - কখনও বা আরও নেমে এসে ভেরোনিকার বন ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্চে।

সাড়ে সাত হাজার ফুটের ওপর থেকে বনের প্রকৃতি একেবারে বদলে গেল। এই পর্য্যন্ত উঠতে ওদের আরও দুদিন লেগেচে। আর অসহ্য কষ্ট, কোমর পিঠ ভেঙে পড়চে। এখানে বনানীর মূর্ত্তি বড় অদ্ভূত, প্রত্যেক গাছের গুঁড়ি ও শাখাপ্রশাখা পুরু শেওলা ঝুলচে - সে শেওলা কোথাও কোথাও এত লম্বা যে, গাছ থেকে ঝুলে প্রায় মাটীতে এসে ঠেকবার মত হয়েচে - বাতাসে সেগুলো আবার দোল খাচ্চে, তার ওপর কোথাও সূর্য্যের আলো নেই, সব সময়ই যেন গোধূলি। আর সবটা ঘিরে বিরাজ করচে এক অপার্থিব ধরণের নিস্তব্ধতা - বাতাস বইচে তারও শব্দ নেই, পাখীর কুজন নেই সে বনে - মানুষের গলার সুর নেই, কোনো জানোয়ারের ডাক নেই। যেন কোন অন্ধকার নরকে দীর্ঘশ্মশ্রূ প্রেতের দলের মধ্যে এসে পড়েচে ওরা। সেদিন অপরাহ্নে যখন আলভারেজ তাঁবু ফেলে বিশ্রাম করবার হুকুম দিলে - তখন তাঁবুর বাইরে বসে এক পাত্র কফি খেতে খেতে শঙ্করের মনে হোল, এ যেন সৃষ্টির আদিম যুগের অরণ্যাণী, পৃথিবীর উদ্ভিদজগৎ যখন কোনো একটা সুনির্দ্দিষ্ট রূপ ও আকৃতি গ্রহণ করেনি, যে যুগে পৃথিবীর বুকে বিরাটকায় সরীসৃপের দল জগৎজোড়া বনজঙ্গলের নিবিড় অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতো - সৃষ্টির সেই অতীত প্রভাতে সে যেন কোন যাদুমন্ত্রের বলে ফিরে গিয়েচে।

সন্ধ্যার পরেই সমগ্র বনানী নিবিড় অন্ধকারে আবৃত হোল। তাঁবুর বাইরে ওরা আগুন করেচে - সেই আলোর মণ্ডলীর বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। এ বনের আশ্চর্য্য নিস্তব্ধতা শঙ্করকে বিস্মিত করেচে। বনানীর সেই বিচিত্র নৈশ শব্দ এখানে স্তব্ধ কেন? আলভারেজ চিন্তিত মুখে ম্যাপ দেখছিল। বল্লে - শোনো শঙ্কর, একটা কথা ভাবচি। আট হাজার ফুট উঠলাম, কিন্তু এখনও পর্ব্বতের সেই খাঁজটা পেলাম না যেটা দিয়ে আমরা রেঞ্জ পার হয়ে ওপারে যাবো। আর কত ওপরে উঠবো? যদি ধরো এই অংশে স্যাডলটা নাই থাকে?

শঙ্করের মনেও এ খটকা যে না জেগেচে তা নয়। সে আজই ওঠবার সময় মাঝে মাঝে ফিল্ড গ্ল্যাস দিয়ে ওপরের দিকে দেখবার চেষ্টা করেচে, কিন্তু ঘন মেঘে বা কুয়াশায় ওপরের দিকটা সর্ব্বদাই আবৃত থাকায় তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সত্যিই তো তারা কত উঠবে আর, সমতল খাঁজ যদি না পাওয়া যায়? আবার নীচে নামতে হবে, আবার অন্য জায়গা বেয়ে উঠতে হবে। দফা সারা।

সে বল্লে - ম্যাপে কি বলে?

আলভারেজের মুখ দেখে মনে হোল ম্যাপের ওপর সে আস্তা হারিয়েচে। বল্লে - এ ম্যাপ অত খুঁটিনাটি ভাবে তৈরী নয়। এ পর্ব্বতে উঠেচে কে যে ম্যাপ তৈরী হবে? এই যে দেখচো - এখানা সার ফিলিপো ডি ফিলিপির তৈরী ম্যাপ, যিনি পর্টুগিজ পশ্চিম আফ্রিকার ফার্ডিনাণ্ডো পো শৃঙ্গ আরোহণ করে খুব নাম করেন, এবং বছর কয়েক আগে বিখ্যাত পর্ব্বত আরোহণকারী পর্য্যটক ডিউক অফ আব্রুৎসির অভিযানেও যিনি ছিলেন। কিন্তু রিখটারসভেল্ড তিনি ওঠেন নি, এ ম্যাপ পাহাড়ের যে কনটুর আঁকা আছে, তা খুব নিখুঁত বলে মনে হয় না। ঠিক বুঝচি নে।

হঠাৎ শঙ্কর বলে উঠল - ও কি?

তাঁবুর বাইরে প্রথমে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ, এবং পরক্ষণেই একটা কষ্টকর কাশির শব্দ পাওয়া গেল - যেন থাইসিসের রোগী খুব কষ্টে কাতর ভাবে কাশচে। একবার...দুবার...তারপরেই শব্দটা থেমে গেল। কিন্তু সেটা মানুষের গলার শব্দ নয়, শুনবা মাত্রেই শঙ্করের সে কথা মনে হোল।

রাইফেল নিয়ে সে ব্যস্তভাবে তাঁবুর বার হতে যাচ্চে, আলভারেজ তাড়াতাড়ি উঠে ওর হাত ধরে বসিয়ে দিলে। শঙ্কর আশ্চর্য্য হয়ে বল্লে - কেন, কিসের শব্দ ওটা?

কথা বলে আলভারেজের দিকে চাইতেই ও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলে আলভারেজের মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েচে, শব্দটা শুনেই কি!

সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর অগ্নিকুণ্ডের মণ্ডলীর বাইরে নিবিড় অন্ধকারে একটা ভারী অথচ লঘুপদ জীব যেন বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে বেশ মনে হোল।

দুজনেই খানিকটা চুপচাপ, তারপরে আলভারেজ বল্লে - আগুনে কাঠ ফেলে দাও। বন্দুক দুটো ভরা আছে কি না দেখ। ওর মুখের ভাব দেখে শঙ্কর ওকে আর কোনো প্রশ্ন করতে সাহস করলে না।

রাত্রি কেটে গেল।

পরদিন সকালে শঙ্করেরই আগে ঘুম ভাঙল। তাঁবুর বাইরে এসে কফি করবার আগুন জ্বালতে সে তাঁবু থেকে কিছুদূরে কাঠ ভাঙতে গেল। হঠাৎ তার নজর পড়ল ভিজে মাটীর ওপর একটা পায়ের দাগ - লম্বায় দাগটা ১১ ইঞ্চির কম নয়, কিন্তু তিনটে মাত্র পায়ে আঙুল। তিন আঙুলেরই দাগ বেশ স্পষ্ট। পায়ের দাগ ধরে সে এগিয়ে গেল - আরও অনেক গুলো সেই পায়ের দাগ আছে, সবগুলোতেই সেই তিন আঙুল।

শঙ্করের মনে পড়ল ইউগাণ্ডার ষ্টেশন ঘরে আলভারেজের মুখে শোনা জিম কার্টারের মৃত্যুকাহিনী। গুহার মুখে বালির ওপর সেই অজ্ঞাত হিংস্র জানোয়ারের তিন আঙুলওয়ালা পায়ের দাগ। কাফির গ্রামের সর্দ্দারের মুখে শোনা গল্প।

আলভারেজের কাল রাত্রের বিবর্ণ মুখও সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। আর একদিনও আলভারেজ ঠিক এই রকমই ভয় পেয়ে ছিল, যেদিন পর্ব্বতের পাদমূলে ওরা প্রথম এসে তাঁবু পাতে।

বুনিপ! কাফির সর্দ্দারের গল্পের সেই বুনিপ! রিখটারসভেল্ড পর্ব্বত ও অরণ্যের বিভীষিকা, যার ভয়ে শুধু অসভ্য মানুষ কেন, অন্য কোনো বন্য জন্তু পর্য্যন্ত এই আট হাজার ফুটের ওপরকার বনে আসে না। কাল রাত্রে কোনো জানোয়ারের শব্দ পাওয়া যায়নি কেন, এখন তা শঙ্করের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আলভারেজ পর্য্যন্ত ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল ওর গলার শব্দ শুনে। বোধ হয় ও শব্দের সঙ্গে আলভারেজের পূর্ব্বে পরিচয় ঘটেছে।

আলভারেজের ঘুম ভাঙতে সেদিন একটু দেরী হোল। গরম কফি এবং কিছু খাদ্য গলাধঃকরণ করবার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার সেই নির্ভীক ও দুদ্ধর্ষ আলভারেজ, যে মানুষকেও ভয় করে না, শয়তানকেও না। শঙ্কর ইচ্ছে করেই আলভারেজকে ঐ অজ্ঞাত জানোয়ারের পায়ের দাগটা দেখালে না - কি জানি যদি আলভারেজ বলে বসে - এখনও পাহাড়ের স্যাডল পাওয়া গেল না, তবে নেমে যাওয়া যাক।

সকালে সেদিন খুব মেঘ করে ঝম্‌ ঝম করে বৃষ্টি নামলো। পর্ব্বতের ঢালু বেয়ে যেন হাজার ঝরণার ধারায় বৃষ্টির জল গড়িয়ে নীচে নামচে। এই বন ও পাহাড় চোখে কেমন যেন ধাঁধা লাগিয়ে দেয়, এতটা উঠেচে ওরা কিন্তু প্রতি হাজার ফুট ওপর থেকে নীচের অরণ্যের গাছপালার মাথা দেখে সেগুলিকে সমতলভূমির অরণ্য বলে ভ্রম হচ্ছে - কাজেই প্রথমটা মনে হয় যেন কতটুকুই বা উঠেচি, ঐটুকু তো।

 বৃষ্টি সেদিন থামলো না - বেলা দশটা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করে আলভারেজ উঠবার হুকুম দিলে। শঙ্কর এটা আশা করেনি। এখানে শঙ্কর কর্ম্মী শ্বেতাঙ্গ-চরিত্রের একটা দিক লক্ষ্য করলে। তার মনে হচ্ছিল, কেন এই বৃষ্টিতে মিছে মিছে বার হওয়া? একটা দিনে কি এমন হবে? বৃষ্টি-মাথায় পথ চলে লাভ?

 অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারার মধ্যে ঘন অরণ্যানী ভেদ করে সেদিন ওরা সারাদিন উঠল। উঠচে, উঠচে, উঠচেই - শঙ্কর আর পারে না। কাপড়-চোপড় জিনিস-পত্র, তাঁবু সব ভিজে একশা, একখানা রুমাল পর্য্যন্ত শুকনো নেই কোথাও - শঙ্করের কেমন একটা অবসাদ এসেচে দেহে ও মনে - সন্ধ্যার দিকে যখন সমগ্র পর্ব্বত ও অরণ্য মেঘের অন্ধকারে ও সন্ধ্যার অন্ধকারে একাকার হয়ে ভীমদর্শন ও গম্ভীর হয়ে উঠল, ওর তখন মনে হোল - এই অজানা দেশে অজানা পর্ব্বতের মাথায় ভয়ানক হিংস্রজন্তুসঙ্কুল বনের মধ্যে দিয়ে, বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়, কোন অনির্দ্দেশ্য হীরকখনি বা তার চেয়েও অজানা মৃত্যর অভিমুখে সে চলেছে কোথায়? আলভারেজ কে তার? তার পরামর্শে কেন সে এখানে এল? হীরার খনিতে তার দরকার নেই। বাংলা দেশের খড়ে ছাওয়া ঘর, ছায়াভরা শান্ত গ্রাম্য পথ, ক্ষুদ্র নদী, পরিচিত পাখীদের কাকলী - সে সব যেন কতদূরের কোন্ অবাস্তব স্বপ্ন-রাজ্যের জিনিস, আফ্রিকার কোনো হীরকখনি তাদের চেয়ে মূল্যবান নয়।

 কিন্তু তার এ ভাব কেটে গেল অনেক রাত্রে, যখন নির্ম্মেঘ আকাশে চাঁদ উঠল। সে অপার্থিব জ্যোৎস্নাময়ী রজনীর বর্ণনা নেই। শঙ্কর আর পৃথিবীতে নেই, বাংলা বলে কোনো দেশ নেই। সব স্বপ্ন হয়ে গিয়েচে - সে আর কোথাও ফিরতে চায় না, হীরা চায় না, অর্থ চায় না - পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বহু ঊর্দ্ধে এক কৌমুদী-শুভ্র দেবলোকের এখন সে অধিবাসী, তার চারিধারে যে সৌন্দর্য্য, কোনো মানুষের চোখ এর আগে তা কখনো দেখেনি। সে গহন নিস্তব্ধতা, এর আগে তা কোনো মানুষ অনুভব করেনি। জনমানবহীন বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্ব্বত ও অরণ্য এই গভীর নিশীথে মেঘলোকে আসন পেতে আপনাতে আপনি আত্মস্থ, ধ্যানস্তিমিত - পৃথিবীর মানুষের সেখানে প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য ক্কচিৎ ঘটে।

 সেই রাত্রে ঘুম থেকে ও ধড়মড়িয়ে উঠল আলভারেজের ডাকে। আলভারেজ ডাকচে - শঙ্কর, শঙ্কর, ওঠো বন্দুক বাগাও -

 —কি-কি-

 তারপর ও কাণ পেতে শুনলে - তাঁবুর চারিপাশে কে যেন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্চে, তার জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্চে তাঁবুর মধ্যে থেকে। চাঁদ ঢলে পড়েচে, তাঁবুর বাইরে অন্ধকারই বেশী, জ্যোৎস্নাটুকু গাছের মগডালে উঠে গিয়েচে, কিছুই দেখা যাচ্চে না। তাঁবুর দরজার মুখে আগুন তখনও একটু একটু জ্বলচে - কিন্তু তার আলোর বৃত্ত যেমন ছোট, আলোর জ্যোতিও ততোধিক ক্ষীণ, তাতে দেখবার সাহায্য কিছুই হয় না।

 হুড়মুড় করে একটা শব্দ হোল - গাছপালা ভেঙে একটা ভারী জানোয়ার হঠাৎ ছুটে পালালো যেন। যেন তাঁবুর সকলে সজাগ হয়ে উঠেচে, এখন আর অতর্কিত শিকারের সুবিধে হবে না, বাইরের জানোয়ারটা তা বুঝতে পেরেচে।

 জানোয়ারটা যাই হোক না কেন, তার যেন বুদ্ধি আছে, বিচারের ক্ষমতা আছে, মস্তিষ্ক আছে।

 আলভারেজ রাইফেল হাতে টর্চ্চ জ্বেলে বাইরে গেল। শঙ্করও গেল ওর পেছনে পেছনে। টর্চ্চের আলোয় দেখা গেল, তাঁবুর উত্তর-পূর্ব্ব কোণের জঙ্গলের চারা গাছপালার ওপর দিয়ে যেন একটা ভারী ষ্টীম রোলার চলে গিয়েচে। আলভারেজ সেইদিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে বার দুই দেওড় করলো।

 কোনো দিকে কোনো শব্দ পাওয়া গেল না।

 তাঁবুতে ফিরবার সময় তাঁবুর ঠিক দরজার মুখে আগুনের কুণ্ডের অতি নিকটেই একটা পায়ের দাগ দু'জনেরই চোখে পড়ল। তিনটা মাত্র আঙ্গুলের দাগ ভিজে মাটীর ওপর সুস্পষ্ট।

 এতে প্রমাণ হয়, জানোয়ারটা আগুনকে ডরায় না। শঙ্করের মনে হোল, যদি ওদের ঘুম না ভাঙতো, তবে সেই অজ্ঞাত বিভীষিকাটী তাঁবুর মধ্যে ঢুকতে একটুও দ্বিধা করতো না - এবং তারপরে কি ঘটত তা কল্পনা করে কোনো লাভ নেই। আলভারেজ বল্লে - শঙ্কর, তুমি তোমার ঘুম শেষ করো, আমি জেগে আছি।

 শঙ্কর বল্লে - না, তুমি ঘুমোও আলভারেজ।

 আলভারেজ ক্ষীণ হাসি হেসে বল্লে - পাগল, তুমি জেগে কিছু করতে পারবে না, শঙ্কর। ঘুমিয়ে পড়ো, ঐ দেখ দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্চে, আবার ঝড় বৃষ্টি আসবে, রাত শেষ হয়ে আসচে, ঘুমোও। আমি বরং একটু কফি খাই।

 রাত ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে এল মুষল ধারে বৃষ্টি, সঙ্গে সঙ্গে তেমনি বিদ্যুৎ, তেমনি মেঘগর্জ্জন। সে বৃষ্টি চলল সমানে সারাদিন, তার বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। শঙ্করের মনে হোল, পৃথিবীতে আজ প্রলয়ের বর্ষণ হয়েছে সুরু, প্রলয়ের দেবতা সৃষ্টি ভাসিয়ে দেবার সূচনা করেচেন বুঝি। বৃষ্টির বহর দেখে আলভারেজ পর্য্যন্ত দমে গিয়ে তাঁবু ওঠাবার নাম মুখে আনতে ভুলে গেল।

 বৃষ্টি থামল যখন, তখন বিকাল পাঁচটা। বোধ হয়, বৃষ্টি না থামলেই ভাল ছিল, কারণ অমনি আলভারেজ চলা শুরু করবার হুকুম দিলে। বাঙ্গালী ছেলের স্বভাবতঃই মনে হয় - এখন অবেলায় যাওয়া কেন? এত কি সময় বয়ে যাচ্চে? কিন্তু আলভারেজের কাছে দিন, রাত, বর্ষা, রৌদ্র, জোৎস্না, অন্ধকার সব সমান। সে রাত্রে বর্ষাস্নাত বনভূমির মধ্যে দিয়ে মেঘভাঙা জোৎস্নার আলোয় দু'জনে উঠচে, উঠচে - এমন সময় আলভারেজ পেছন থেকে বলে উঠল - শঙ্কর দাঁড়াও, ঐ দেখ -

 আলভারেজ ফিল্ড গ্লাস্ দিয়ে ফুটফুটে জোৎস্নালোকে বাঁ পাশের পর্ব্বত-শিখরের দিকে চেয়ে দেখচে। শঙ্কর ওর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে। হাঁ, সমতল খাঁজটা পাওয়া গিয়েচে! বেশী দূরেও নয়, মাইল দুইয়ের মধ্যে, বাঁদিক ঘেঁসে।

 আলভারেজ হাসিমুখে বল্লে - দেখেচ স্যাডলটা? থামবার দরকার নেই, চল আজ রাত্রেই স্যাডলের ওপর পৌঁছে তাঁবু ফেলবো। শঙ্কর আর সত্যিই পারচে না। এ দুদ্ধর্ষ পর্টুগিজটার সঙ্গে হীরার সন্ধানে এসে সে কি ঝকমারী না করেচে! শঙ্কর জানে অভিযানের নিয়মনুযায়ী দলপতির হুকুমের ওপর কোনো কথা বলতে নেই। এখানে আলভারেজই দলপতি, তার আদেশ অমান্য করা চলবে না। কোথাও আইনে লিপিবদ্ধ না থাকলেও, পৃথিবীর ইতিহাসের বড় বড় অভিযানে সবাই এই নিয়ম মেনে চলে। সেও মানবে।

 অবিশ্রান্ত হাঁটবার পরে সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ওরা এসে স্যাডলে যখন উঠল - শঙ্করের তখন আর এক পাও চলবার শক্তি নেই।

 স্যাডলটার বিস্তৃতি তিন মাইলের কম নয়, কখনো বা দুশো ফুট খাড়া উঠচে, কখনো বা চার পাঁচশো ফুট নেমে গেল একমাইলের মধ্যে, সুতরাং বেশ দুরারোহ - যতটুকু সমতল, ততটুকু শুধুই বড় বড় বনস্পতির জঙ্গল, ইরিথ্রিনা, পেনসিয়ানা, বিঠাগাছ, বাঁশ, বন্য আদা। বিচিত্র বর্ণের অর্কিডের ফুল ডালে ডালে। বেবুন ও কলোবাস্ বানর সর্ব্বত্র।

 আরও দুদিন ধরে ক্রমাগত নামতে নামতে ওরা রিখটারসভেল্ড পর্ব্বতের আসল রেঞ্জের ওপারের উপত্যকায় গিয়ে পদার্পণ করলো। শঙ্করের মনে হোল, এদিকে জঙ্গল যেন আরও বেশী দুর্ভেদ্য ও বিচিত্র। আটলাণ্টিক মহাসাগরের দিক থেকে সমুদ্রবাষ্প উঠে কতক ধাক্কা খায় পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুণ পর্ব্বতে, বাকীটা আটকায় বিশাল রিখটারসভেল্ডের দক্ষিণ সানুতে - সুতরাং বৃষ্টি এখানে হয় অজস্র, গাছপালার তেজও তেমনি।

 দিন পনেরো ধরে সে বিরাট অরণ্যাকীর্ণ উপত্যকার সর্ব্বত্র দুজনে মিলে খুঁজেও আলভারেজ বর্ণিত পাহাড়ী নদীর কোনো ঠিকানা বার করতে পারলে না। ছোটখাটো ঝরণা দুএকটা উপত্যকার উপর দিয়ে বইচে বটে - কিন্তু আলভারেজ কেবলই ঘাড় নাড়ে আর বলে - এ সব নয়।

 শঙ্কর বলে - তোমার ম্যাপ দেখো না ভালো করে? কিন্তু এখন দেখা যাচ্চে যে আলভারেজের ম্যাপের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আলভারেজ বলে - ম্যাপ কি হবে? আমার মনে গভীর ভাবে আঁকা আছে সে নদী ও সে উপত্যকার ছবি সে একবার দেখতে পেলেই তখুনি চিনে নেবো। এ সে জায়গায়ই নয়, এ উপত্যকাই নয়।

 নিরুপায়। খোঁজো তবে।

 একমাস কেটে গেল। পশ্চিম আফ্রিকায় বর্ষা নামল মার্চ্চ মাসের প্রথমে। সে কী ভয়ানক বর্ষা! শঙ্কর তার কিছু নমুনা পেয়ে এসেচে রিখটারসভেল্ড পার হবার সময়ে। উপত্যকা ভেসে গেল পাহাড় থেকে নামা বড় বড় পার্ব্বত্য ঝরণার জলধারায়। তাঁবু ফেলবার স্থান নেই। একরাত্রে হঠাৎ অতিবর্ষণের ফলে ওদের তাঁবুর সামনের একটা নিরীহ ক্ষীণকায়া ঝরণা ধারা ভীমমূর্ত্তি ধারণ করে ওদের তাঁবুশুদ্ধ ওদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবার যোগাড় করেছিল - আলভারেজের সজাগ ঘুমের জন্যে সে যাত্রা বিপদ কেটে গেল।

 কিন্তু দিন যায় তো ক্ষণ যায় না। শঙ্কর একদিন ঘোর বিপদে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। সে বিপদটাও বড় অদ্ভূত ধরণের।

 সেদিন আলভারেজ তাঁবুতে তার নিজের রাইফেল পরিষ্কার করছিল, সেটা শেষ করে রান্না করবে কথা ছিল। শঙ্কর রাইফেল হাতে বনের মধ্যে শিকারের সন্ধানে বার হয়েচে।

 আলভারেজ বলে দিয়েচে তাকে এ বনে খুব সতর্ক হয়ে সাবধানে চলাফেরা করতে - আর বন্দুকের ম্যাগাজিনে সব সময় যেন কাট্রিজ ভরা থাকে। আর একটা খুব মূল্যবান উপদেশ দিয়েচে, সেটা এই - বনের মধ্যে বেড়াবার সময় হাতের কব্জিতে কম্পাস্ বেঁধে নিয়ে বেড়াবে এবং যে পথ দিয়ে যাবে, সে পথের ধারে গাছপালায় কোনো চিহ্ন রেখে যাবে, যাতে ফিরবার সময় সেই সব চিহ্ন ধরে আবার ঠিক ফিরতে পারো। নতুবা বিপদ অবশ্যম্ভাবী।

 একদিন শঙ্কর স্প্রিংবক্ হরিণের সন্ধানে গভীর বনে চলে গিয়েচে। সকালে বেরিয়েছিল, ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে একজায়গায় একটা গাছের তলায় সে একটু বিশ্রামের জন্যে বসল।

 সেখানটাতে চারিধারেই বৃহৎ বৃহৎ বনস্পতির মেলা, আর সব গাছেই গুঁড়ি ও ডালপালা বেয়ে একপ্রকারের বড় বড় লতা উঠে তাদের ছোট ছোট পাতা দিয়ে এমনি নিবিড় ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে গাছগুলো জড়িয়েচে যে গুঁড়ির আসল রং দেখা যায় না। কাছেই একটা ছোট্ট জলার ধারে ঝাড়ে ঝাড়ে মারি পোসা লিলি ফুটে রয়েচে।

 খানিকটা সেখানে বসবার পরে শঙ্করের মনে হোল তার কি একটা অস্বস্তি হচ্চে। কি ধরণের অস্বস্তি তা সে কিছু বুঝতে পারলে না - অথচ জায়গাটা ছেড়ে উঠে যাবারও ইচ্ছে হোল না - সে কান্তও বটে, আর জায়গাটাও বেশ আরামেরও বটে।

 কিন্তু এ তার কি হোল? তার সমস্ত শরীরে এত অবসাদ কোথা থেকে এল? ম্যালেরিয়া জ্বরে ধরল নাকি?

 অবসাদটা কাটাবার জন্যে সে পকেট হাতড়ে একটা চুরুট বার করে ধরালে। কিসের একটা মিষ্টি মিষ্টি সুগন্ধ বাতাসে - শঙ্করের বেশ লাগচে গন্ধটা। একটু পরে দেশলাইটা মাটী থেকে কুড়িয়ে পকেটে রাখতে গিয়ে মনে হোল, হাতটা যেন তার নিজের নেই - যেন আর কারো হাত, তার মনের ইচ্ছায় সে হাত নড়ে না।

 ক্রমে তার সর্ব্বশরীর যেন বেশ একটা আরাম দায়ক অবসাদে অবশ হয়ে পড়তে চাইল। কি হবে বৃথা ভ্রমণে, আলেয়ার পিছু পিছু বৃথা ছুটে, এই রকম বনের ঘন ছায়ায় নিভৃত লতাবিতানে অলস স্বপ্নে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার চেয়ে সুখ আর কি আছে?

 একবার তার মনে হোল, এই বেলা উঠে তাঁবুতে যাওয়া যাক, নতুবা তার কোনো একটা বিপদ ঘটবে যেন। একবার সে উঠবার চেষ্টাও করতে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই তার দেহমনব্যাপী অবসাদের জয় হোল। অবসাদ নয়, যেন একটা মৃদুমধুর নেশার আনন্দ। সমস্ত জগৎ তার কাছে তুচ্ছ। সে নেশাটাই তার সারাদেহ অবশ করে আনচে ক্রমশঃ।

 শঙ্কর গাছের শিকড়ে মাথা দিয়ে ভাল করেই শুয়ে পড়ল। বড় বড় কটন উড গাছের ডালে শাখায় আলোছায়ার রেখা বড় অস্পষ্ট, কাছেই কোথাও বন্য পেচকের ধ্বনি অনেকক্ষণ থেকে শোনা যাচ্ছিল, ক্রমে যেন তা ক্ষীণতর হয়ে আসচে। তারপরে কি হোল শঙ্কর আর কিছু জানে না।

আলভারেজ যখন বহু অনুসন্ধানের পর ওর অচৈতন্য দেহটা কটন্ উড্ জঙ্গলের ছায়ায় আবিষ্কার করলে, তখন বেলা বেশী নেই। প্রথমটা আলভারেজ মনে ভাবলে, এ নিশ্চয়ই সর্পাঘাত - কিন্তু দেহটা পরীক্ষা করে সর্পাঘাতের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। হঠাৎ মাথার ওপরকার ডালপালা ও চারিধারে গাছপালার দিকে নজর পড়তেই অভিজ্ঞ ভ্রমণকারী আলভারেজ ব্যাপারটা সব বুঝতে পারলে। সেখানটাতে সর্ব্বত্র অতি মারাত্মক বিষ-লতার বন (Poison Ivy) - যার রসে আফ্রিকার

200

অসভ্য মানুষেরা তীরের ফলা ডুবিয়ে নেয়। যার বাতাস এমনি সুগন্ধ বহন করে, কিন্তু নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেশী মাত্রায় গ্রহণ করলে, অনেক সময় পক্ষাঘাত পর্য্যন্ত হতে পারে, মৃত্যু ঘটাও আশ্চর্য্য নয়।

 তাঁবুতে এসে শঙ্কর দুতিন দিন শয্যাগত হয়ে রইল। সর্ব্বশরীর ফুলে ঢোল। মাথা যেন ফেটে যাচ্চে আর সর্ব্বদাই তৃষ্ণায় গলা কাঠ। আলভারেজ বলে - যদি তোমাকে সারা রাত ওখানে থাকতে হোত - তা হোলে সকালবেলা তোমাকে বাঁচানো কঠিন হোত।

 একদিন একটা ঝরণার জলধারার বালুময় তীরে শঙ্কর হলদে রঙের কি দেখতে পেলে। আলভারেজ পাকা প্রসপেক্টর, সে এসে বালি ধুয়ে সোনার রেণু বার করলে - কিন্তু তাতে সে বিশেষ উৎসাহিত হোল না। সোনার পরিমাণ এত কম যে মজুরি পোষাবে না - এক-টন বালি ধুয়ে আউন্স তিনেক সোনা পাওয়া হয়তো যেতে পারে।

 শঙ্কর বল্লে - বসে থেকে লাভ কি, তবু যা সোনা পাওয়া যায়, তিন আউন্স সোনার দামও তো কম নয়।

 সে যেটাকে অত্যন্ত অদ্ভুত জিনিষ বলে মনে করেচে, অভিজ্ঞ প্রসপেক্টার আলভারেজের কাছে সেটা কিছুই নয়। তাছাড়া শঙ্করের মজুরির ধারণার সঙ্গে আলভারেজের মজুরির ধারণা মিল খায় না। শেষ পর্য্যন্ত ও কাজ শঙ্করকে ছেড়ে দিতে হোল।

 ইতিমধ্যে ওরা মাসখানেক ধরে জঙ্গলের নানা অঞ্চলে বেড়ালে। আজ এখানে দুদিন তাঁবু পাতে, সেখান থেকে আর এক জায়গায় উঠে যায়, সেখানে কিছুদিন তন্ন তন্ন করে চারিধার দেখবার পরে আর এক জায়গায় উঠে যায়। সেদিন অরণ্যের একটা স্থানে ওরা নতুন পৌঁছে তাঁবু পেতেছে। শঙ্কর বন্দুক নিয়ে দুএকটা পাখী শিকার করে সন্ধ্যায় তাঁবুতে ফিরে এসে দেখলে, আলভারেজ বসে চুরুট টানচে, তার মুখ দেখে মনে হোল সে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত।

 শঙ্কর বল্লে - আমি বলি আলভারেজ, তুমিই যখন বার করতে পারলে না, তখন চলো ফিরি।

 আলভারেজ বল্লে - নদীটা তো উড়ে যায় নি, এই বন পর্ব্বতের কোনো না কোনো অঞ্চলে সেটা নিশ্চয়ই আছে।

 — তবে আমরা বার করতে পারচি নে কেন?

 — আমাদের খোঁজা ঠিকমত হচ্চে না।

 — বল কি আলভারেজ, ছমাস ধরে জঙ্গল চষে বেড়াচ্চি, আবার কাকে খোঁজা বলে?

 আলভারেজ গম্ভীর মুখে বল্লে - কিন্তু মুস্কিল হয়েচে জানো, শঙ্কর? তোমাকে এখনও কথাটা বলি নি, শুনলে হয়তো খুব দমে যাবে বা ভয় পাবে। আচ্ছা তোমাকে একটা জিনিস দেখাই, এসো আমার সঙ্গে।

 শঙ্কর অধির আগ্রহ ও কৌতূহলের সঙ্গে ওর পেছনে পেছনে চললো। ব্যাপারটা কি?

 আলভারেজ একটু দূরে গিয়ে একটা বড় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বল্লে - শঙ্কর, আমরা আজই এখানে এসে তাঁবু পেতেছি, ঠিক তো?

 শঙ্কর অবাক হয়ে বল্লে - এ কথার মানে কি? আজই তো এখানে এসেচি না আবার কবে এসেচি?

 — আচ্ছা, এই গাছের গুঁড়ির কাছে সরে এসে দেখো তো?  শঙ্কর এগিয়ে গিয়ে দেখলে, গুঁড়ির নরম ছাল ছুরি দিয়ে খুদে কে 'D.A.' লিখে রেখেচে - কিন্তু লেখাটা টাটকা নয়, অন্ততঃ মাসখানেকের পুরানো।

 শঙ্কর ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলে না। আলভারেজের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আলঅভারেজ বল্লে - বুঝতে পারলে না? এই গাছে আমিই মাসখানেক আগে আমার নামের অক্ষর দুটী খুদে রাখি। আমার মনে একটু সন্দেহ হয়। তুমি তো বুঝতে পারো না, তোমার কাছে সব বনই সমান। এর মানে এখন বুঝেচ? আমরা চক্রাকারে বনের মধ্যে ঘুরচি। এ সব জায়গায় যখন এ রকম হয়, তখন তা থেকে উদ্ধার পাওয়া বেজায় শক্ত।

 এতক্ষণে শঙ্কর বুঝলে ব্যাপারটা। বল্লে - তুমি বলতে চাও মাসখানেক আগে আমরা এখানে এসেছিলাম?

 —ঠিক তাই। বড় অরণ্যে বা মরুভূমিতে এই বিপদ ঘটে। একে বলে death circle, আমার মনে মাসখানেক আগে প্রথম সন্দেহ হয় যে, হয়তো আমরা death circle এ পড়েচি। সেটা পরীক্ষা করে দেখবার জন্যেই গাছের ছালে ঐ অক্ষর খুদে রাখি। আজ বনের মধ্যে বেড়াতে হঠাৎ চোখে পড়ল।

 শঙ্কর বল্লে - আমাদের কম্পাসের কি হোল? কম্পাস থাকতে দিকভুল হচ্ছে কি ভাবে রোজ রোজ?

 আলভারেজ বল্লে - আমার মনে হয় কম্পাস খারাপ হয়ে গিয়েচে। রিখটারসভেল্ড পার হবার সময় সেই যে ভয়ানক ঝড় ও বিদ্যুৎ হয়, তাতেই কি ভাবে ওর চৌম্বক শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েচে।

 — তা হোলে আমাদের কম্পাস এখন অকেজো?

 — আমার তাই ধারণা।  শঙ্কর দেখলে অবস্থা নিতান্ত মন্দ নয়। ম্যাপ ভুল, কম্পাস অকেজো, তার ওপর ওরা পড়েচে এক ভীষণ দুর্গম গহণারণ্যের মাঝে বিষম মরণ ঘূর্ণীতে। জনমানুষ নেই, খাবার নেই, জলও নেই বল্লেই হয়, কারণ যেখানকার সেখানকার জল যখন পানের উপযুক্ত নয়। থাকার মধ্যে আছে এক ভীষণ, অজ্ঞাত মৃত্যুর ভয়। জিম কার্টার এই অভিশপ্ত অরণ্যানীর মধ্যে রত্নের লোভে এসে প্রাণ দিয়েছিল, এখানে কারো মঙ্গল হবে বলে মনে হয় না।

 আলভারেজ কিন্তু দমে যাবার পাত্রই নয়। সে দিনের পর দিন চলল বনের মধ্যে দিয়ে। বনের কোনো কূল-কিনারা পায় না শঙ্কর, আগে যাও বা ছিল, ঘূর্ণীপাকে তারা ঘুরচে শোনা অবধি, শঙ্করের দিক সম্বন্ধে জ্ঞান একেবার লোপ পেয়েচে।

 দিন তিনেক পরে ওরা একটী জায়গায় এসে উপস্থিত হোল, সেখানে রিখটারসভেল্ডের একটী শাখা আসল পর্ব্বতমালার সঙ্গে সমকোণ করে উত্তর দিকে লম্বালম্বি হয়ে আছে। খুব কম হোলেও সেটা ৪০০০ হাজার ফুট উঁচু। আরও পশ্চিম দিকে একটা খুব উঁচু পর্ব্বতচূড়া ঘন মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। দুই পাহাড়ের মধ্যেকার উপত্যকা তিন মাইল বিস্তীর্ণ হবে এবং এই উপত্যকা খুব ঘন জঙ্গলে ভরা।

 বনে গাছপালার যেন তিনটে চারটে থাক্‌। সকলের উপরের থাকে শুধুই পরগাছা আর শেওলা, মাঝের থাকে ছোট বড় বনস্পতির ভিড়, নিচের থাকে ঝোপঝাপ, ছোট ছোট গাছ। সূর্যের আলোর বালাই নেই বনের মধ্যে।

 আলভারেজ বনের মধ্যে না ঢুকে বনের ধারেই তাঁবু ফেলতে বললে। সন্ধ্যার সময় ওরা কফি খেতে খেতে পরামর্শ করতে বসল যে, এখন কি করা যাবে। খাবার একদম ফুরিয়েছে, চিনি অনেকদিন থেকেই নেই, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে আর দু-এক দিন পরে কফিও শেষ হবে। সামান্য কিছু ময়দা এখনো আছে— কিন্তু আর কিছুই নেই। ময়দা এই জন্যে আছে যে, ওরা ও জিনিসটা কালেভদ্রে ব্যবহার করে। ওদের প্রধান ভরসা বন্য জন্তুর মাংস, কিন্তু সঙ্গে যখন ওদের গুলি বারুদের কারখানা নেই, তখন শিকারের ভরসাই বা চিরকাল করা যায় কি করে?

 কথা বলতে বলতে শঙ্কর দূরের যে পাহাড়ের চূড়াটা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে, সেদিকে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখছিল। এই সময়ে অল্পক্ষণের জন্যে মেঘ সম্পূর্ণ সরে গেল। চূড়াটার অদ্ভুত চেহারা, যেন কুলফি বরফের আগার দিকটা কে এক কামড়ে খেয়ে ফেলেছে।

আলভারেজ বললে— এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বুলাওয়েও কি সলস্‌বেরি চারশো থেকে পাঁচশো মাইলের মধ্যে। মধ্যে শ-দুই মাইল মরুভূমি। পশ্চিম দিকে উপকূল তিনশো মাইলের মধ্যে বটে, কিন্তু পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকা অতি ভীষণ দুর্গম জঙ্গলে ভরা, সুতরাং সেদিকের কথা বাদ দাও। এখন আমাদের উপায় হচ্ছে, হয় তুমি নয় আমি সলস্‌বেরি কি বুলাওয়েও চলে গিয়ে টোটা ও খাবার কিনে আনি। কম্পাসও চাই।

 আলভারেজের মুখে এই কথাটা বড় শুভক্ষণে শঙ্কর শুনেছিল। দৈব মানুষের জীবনে যে কত কাজ করে, তা মানুষে কি সব সময় বোঝে? দৈবক্রমে ‘বুলাওয়েও’ এবং ‘সলস্‌বেরি’ দুটো শহরের নাম, তাদের অবস্থানের দিক ও এই জায়গাটা থেকে তাদের আনুমানিক দূরত্ব শঙ্করের কানে গেল। এর পরে সে কতবার মনে মনে আলভারেজকে ধন্যবাদ দিয়েছিল এই নাম দুটো বলবার জন্যে।

 কথাবার্তা সেদিন বেশি অগ্রসর হল না। দু’জনেই পরিশ্রান্ত ছিল, সকাল সকাল শয্যা আশ্রয় করলে।