চাঁদের পাহাড়/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
তেরো
দুপুরের রোদে যখন দিক-দিগন্তে আগুন জ্বলে উঠ্লো, একটা ছোট্ট পাথরের ঢিবির আড়ালে সে আশ্রয় নিলে। ১৩৫° ডিগ্রী উত্তাপ উঠেচে তাপমান যন্ত্রে, রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে এ উত্তাপে পথহাঁটা চলে না। যদি সে কোনরকমে এই ভয়ানক মরুভূমির হাত এড়াতে পারতো, তবে হয়তো জীবন্ত অবস্থায় মানুষের আবাসে পৌঁছুতেও পারতো। সে ভয় করে শুধু এই মরুভূমি, সে জানে কালাহারী মরু বড় বড় সিংহের বিচরণভূমি। তার হাতে রাইফেল আছে—রাতদুপুরেও একা যত বড় সিংহই হোক, সম্মুখীন হতে সে ভয় করে না—কিন্তু ভয় হয় তৃষ্ণা রাক্ষসীকে। তার হাত থেকে পরিত্রাণ নেই। দুপুরে সে দু’বার মরীচিকা দেখলে। এতদিন মরুপথে আসতেও এ আশ্চর্য্য নৈসর্গিক দৃশ্য দেখেনি, বইয়েই পড়েছিল মরীচিকার কথা। একবার উত্তর পূর্ব্ব কোণে, একবার দক্ষিণ পূর্ব্ব কোণে, দুই মরীচিকাই কিন্তু প্রায় এক রকম—অর্থাত্ একটা বড় গম্বুজওয়ালা মসজিদ বা গির্জ্জা, চারপাশে খর্জ্জুরকুঞ্জ, সামনে বিস্তৃত জলাশয়। উত্তরপূর্ব্ব কোণের মরীচিকাটা বেশী স্পষ্ট।
সন্ধ্যার দিকে দূরদিগন্তে মেঘমালার মত পর্ব্বতমালা দেখা গেল। শঙ্কর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলে না। পূর্ব্বদিকে একটাই মাত্র বড় পর্ব্বত, এখান থেকে দেখা পাওয়া সম্ভব, দক্ষিণ রোডেসিয়ার প্রান্তবর্ত্তী চিমানিমানি পর্ব্বতমালা। তাহোলে কি বুঝতে হবে যে, সে বিশাল কালাহারি পদব্রজে পার হয়ে প্রায় শেষ করতে চলেচে? না এ-ও মরীচিকা?
কিন্তু রাত দশটা পর্য্যন্ত পথ চলেও জ্যোত্স্নারাত্রে সে দূর পর্ব্বতের সীমারেখা তেমনি স্পষ্ট দেখতে পেল। অসংখ্য ধন্যবাদ হে ভগবান, মরীচিকা নয় তবে। জ্যোত্স্নারাত্রে কেউ কখনো মরীচিকা দেখেনি।
তবে কি প্রাণের আশা আছে? আজ পৃথিবীর বৃহত্তম রত্নখনির মালিক সে। নিজের পরিশ্রমে ও দুঃসাহসের বলে সে তার স্বত্ব অর্জ্জন করেচে। দরিদ্র বাংলা মায়ের বুকে সে যদি আজ বেঁচে ফেরে!
দু’দিনের দিন বিকেলে সে এসে পর্ব্বতের নিচে পৌঁছলো। তখন সে দেখলে, পর্ব্বত পার হওয়া ছাড়া ওপারে যাওয়ার কোনো সহজ উপায় নেই। নইলে পঁচিশ মাইল মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পর্ব্বতের দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে আসতে হবে। মরুভূমির মধ্যে সে আর কিছুতেই যেতে রাজি নয়। সে পাহাড় পার হয়েই যাবে।
এইখানে সে প্রকাণ্ড একটা ভুল করলে। সে ভুলে গেল যে সাড়ে বারো হাজার ফুট একটা পর্ব্বতমালা ডিঙিয়ে ওপারে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। রিখটারসভেল্ড পার হওয়ার মতোই শক্ত। তার চেয়েও শক্ত, কারণ সেখানে আলভারেজ ছিল। এখানে সে একা। শঙ্কর ব্যাপারের গুরুত্বটা তেমন বুঝতে পারলে না, ফলে চিমানিমানি পর্ব্বত উত্তীর্ণ হতে গিয়ে প্রাণ হারাতে বসলো, ভীষণ প্রজ্বলন্ত কালাহারি পার হতে গিয়েও সে এমন ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হয়নি।
চিমানিমানি পর্ব্বতে জঙ্গল খুব বেশি ঘন নয়। শঙ্কর প্রথম দিন অনেকটা উঠলো— তারপর একটা জায়গায় গিয়ে পড়লো, সেখান থেকে কোনো দিকে যাবার উপায় নেই। কোন পথটা দিয়ে উঠেছিল, সেটাও আর খুঁজে পেলে না— তার মনে হোল, সে সমতলভূমির যে জায়গা দিয়ে উঠেছিল, তার ত্রিশ ডিগ্রী দক্ষিণে চলে এসেচে। কেন যে এমন হোল, এর কারণ কিছুতেই সে বার করতে পারলে না। কোথা দিয়ে কোথায় চলে গেল, কখনো উঠচে, কখনো নামচে, সূর্য্য দেখে দিক ঠিক করে নিচ্চে, কিন্তু সাত আট মাইল পাহাড় উত্তীর্ণ হতে এতদিন লাগচে কেন?
তৃতীয় দিনে আর একটা নতুন বিপদ ঘটল। তার আগের দিন একখানা আলগা পাথর গড়িয়ে তার পায়ে চোট লেগেছিল। তখন তত কিছু হয়নি, পরদিন সকালে আর সে শয্যা ছেড়ে উঠতে পারে না। হাঁটু ফুলেচে, বেদনাও খুব। দুর্গম পথে নামা-ওঠা করা এ অবস্থায় অসম্ভব। পাহাড়ের একটা ঝরনা থেকে ওঠবার সময় জল সংগ্রহ করে এনেছিল, তাই একটু একটু করে খেয়ে চালাচ্চে। পায়ের বেদনা কমে না যাওয়া পর্য্যন্ত তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। বেশীদূর যাওয়া চলবে না। সামান্য একটু-আধটু চলাফেরা করতেই হবে খাদ্য ও জলের চেষ্টায়, ভাগ্যে পাহাড়ের এই স্থানটা যেন খানিকটা সমতলভূমির মতো, তাই রক্ষে।
এই সব অবস্থায়, এই মনুষ্যবাসহীন পাহাড়ে বিপদ তো পদে পদেই। একা এ পাহাড় টপকাতে গেলে যে কোনো ইউরোপীয় পর্যটকেরও ঠিক এইরকম বিপদ ঘটতে পারতো।
শঙ্কর আর পারে না। ওর হৃত্পিণ্ডে কি একটা রোগ হয়েচে, একটু হাঁটলেই ধড়াস ধড়াস করে হৃত্পিণ্ডটা পাঁজরায় ধাক্কা মারে। অমানুষিক পথশ্রমে, দুর্ভাবনায়, অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে, কখনও বা অনাহারের কষ্টে, ওর শরীরে কিছু নেই।
চারদিনের দিন সন্ধ্যাবেলা অবসন্ন দেহে সে একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিলে। খাদ্য নেই কাল থেকে। রাইফেল সঙ্গে আছে, কিন্তু একটা বন্য জন্তুর দেখা নেই। দুপুরে একটা হরিণকে চরতে দেখে ভরসা হয়েছিল, কিন্তু রাইফেলটা তখন ছিল পঞ্চাশ গজ তফাতে একটা গাছে ঠেস দেওয়া, আনতে গিয়ে হরিণটা পালিয়ে গেল। জল খুব সামান্যই আছে চামড়ার বোতলে। এ অবস্থায় নেমে সে ঝরণা থেকে জল আনবেই বা কি করে? হাঁটুটা আরও ফুলেচে। বেদনা এত বেশী যে একটু চলাফেরা করলেই মাথার শির পর্য্যন্ত ছিঁড়ে পড়ে যন্ত্রণায়।
পরিষ্কার আকাশতলে আর্দ্রতাশূন্য বায়ুমণ্ডলের গুণে অনেকদূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্চে। দিকচক্রবালে মেঘলা করে ঘিরেচে নীল পর্ব্বতমালা দূরে দূরে। দক্ষিণ-পশ্চিমে দিগন্ত বিস্তীর্ণ কালাহারী। দক্ষিণে ওয়াহকুক পর্ব্বত, তারও অনেক পিছনে মেঘের মত দৃশ্যমান পল ক্রুগার পর্ব্বতমালা— সলস্বেরির দিকে কিছু দেখা যায় না, চিমানিমানি পর্ব্বতের এক উচ্চতর শৃঙ্গ সেদিকে দৃষ্টি আটকেচে।
আজ দুপুর থেকে ওর মাথার উপর শকুনির দল উড়চে। এতদিন এত বিপদেও শঙ্করের যা হয়নি, আজ শকুনির দল মাথার উপর উড়তে দেখে সত্যই ওর ভয় হয়েচে। ওরা তাহোলে কি বুঝেচে যে শিকার জুটবার বেশী দেরী নেই?
সন্ধ্যার কিছু পরে কি একটা শব্দ শুনে চেয়ে দেখলে, পাশেই এক শিলাখণ্ডের আড়ালে একটা ধূসর রঙের নেকড়ে বাঘ— নেকড়ের লম্বা ছুঁচালো কাণ দুটো খাড়া হয়ে আছে, সাদা সাদা দাঁতের উপর দিয়ে রাঙা জিভটা অনেকখানি বার হয়ে লকলক করচে। চোখে চোখ পড়তেই সেটা চট করে পাথরের আড়াল থেকে সরে দূরে পালালো।
নেকড়ে বাঘটাও তাহোলে কি বুঝেছে? পশুরা নাকি আগে থেকে অনেক কথা জানতে পারে।
হাড়ভাঙ্গা শীত পড়লো রাত্রে। ও কিছু কাঠকুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বাললে। অগ্নিকুণ্ডের আলো যতটুকু পড়েছে তার বাইরে ঘন অন্ধকার।
কি একটা জন্তু এসে অগ্নিকুণ্ড থেকে কিছুদূরে অন্ধকারে দেহ মিশিয়ে চুপ করে বসলো। কোয়োট, বন্যকুকুর জাতীয় জন্তু। ক্রমে আর একটা, আর দুটো, আর তিনটে। রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে দশ-পনেরোটা এসে জমা হোল। অন্ধকারে তার চারিধার ঘিরে নিঃশব্দে অসীম ধৈর্য্যের সঙ্গে যেন কিসের প্রতীক্ষা করচে।
কি সব অমঙ্গল জনক দৃশ্য!
ভয়ে ওর গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। সত্যিই কি এতদিনে তারও মৃত্যু ঘনিয়ে এসেচে?
এতদিন পরে এল তাহোলে! সে-ও পারলে না রিখটার্সভেল্ড থেকে হীরে নিয়ে পালিয়ে যেতে!
উঃ, আজ কত টাকার মালিক সে। হীরের খনি বাদ যাক, তার সঙ্গে যে ছ’খানা হীরে রয়েচে, তার দাম অন্ততঃ দু-তিন লক্ষ টাকা নিশ্চয়ই হবে। তার গরিব গ্রামে, গরিব বাপ মায়ের বাড়ী যদি সে এই টাকা নিয়ে গিয়ে উঠতে পারতো… কত গরীবের চোখের জল মুছিয়ে দিতে পারতো, গ্রামের কত দরিদ্র কুমারীকে বিবাহের যৌতুক দিয়ে ভালো পাত্রে বিবাহ দিত, কত সহায়হীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার শেষ ক’টা দিন নিশ্চিন্ত করে তুলতে পারতো…
কিন্তু সে সব ভেবে কি হবে, যা হবার নয়? তার চেয়ে এই অপূর্ব্ব রাত্রির নক্ষত্রালোকিত আকাশের শোভা, এই বিশাল পর্ব্বত ও মরুভূমির নিস্তব্ধ গম্ভীর রূপ, মৃত্যুর আগে শঙ্করও চায় চোখ ভরে দেখতে, সেই ইটালিয়ান যুবক গাত্তির মত। ওরা যে অদৃষ্টের এক অদৃশ্য তারে গাঁথা সবাই — আত্তিলিও গাত্তি ও তার সঙ্গীরা, জিম কার্টার, আলভারেজ, শঙ্কর।
রাত গভীর হয়েচে। কি ভীষণ শীত! একবার সে চেয়ে দেখলে, কোয়োটগুলো এরি মধ্যে কখন আরও কাছে সরে এসেচে। অন্ধকারের মধ্যে আলো পড়ে তাদের চোখগুলো জ্বলচে। শঙ্কর একখানা জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারতেই ওরা সব দূরে সরে গেল, কিন্তু কি নিঃশব্দ ওদের গতিবিধি আর কি অসীম তাদের ধৈর্য্য! শঙ্করের মনে হোল, এরা জানে শিকার ওদের হাতের মুঠোয়, হাতছাড়া হবার কোনো উপায় নেই।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যাবেলার সেই ধূসর নেকড়ে বাঘটাও দু-দুবার এসে অন্ধকারে কোয়োটদের পিছনে বসে দেখে গিয়েচে।
একটুও ঘুমুতে ভরসা হল না ওর। কি জানি, কোয়োট আর নেকড়ের দল হয়তো তাহোলে জীবন্তই তাকে ছিঁড়ে খাবে মৃত মনে করে। অবসন্ন, ক্লান্ত দেহে জেগেই বসে থাকতে হবে তাকে। ঘুমে চোখ ঢুলে আসলেও উপায় নেই। মাঝে মাঝে কোয়োটগুলো এগিয়ে এসে বসে, ও জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারতেই সরে যায়। দু-একটা হায়েনাও এসে ওদের দলে যোগ দিয়েচে, হায়েনাদের চোখগুলো অন্ধকারে কি ভীষণ জ্বলে!
কি ভয়ানক অবস্থাতে সে পড়েচে! জনবিরল বর্ব্বর দেশের জনশূন্য পর্ব্বতের সাড়ে তিন হাজার ফুট উপরে সে চলৎশক্তি হীন অবস্থায় বসে… গভীর রাত, ঘোর অন্ধকার… সামান্য আগুন জ্বলচে। মাথার ওপর জলকণাশূন্য স্তব্ধ বায়ুমণ্ডলের গুণে আকাশের অগণ্য তারা জ্বলজ্বল করচে যেন ইলেকট্রিক আলোর মত… নীচে তার চারিধার ঘিরে অন্ধকারে মাংসলোলুপ নীরব নেকড়ে, কোয়োট, হায়েনার দল।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার এটাও মনে হোল, বাংলার পাড়াগাঁয়ে ম্যালেরিয়ায় ধুঁকে সে মরচে না। এ মৃত্যু বীরের মৃত্যু! পদব্রজে কালাহারি মরুভূমি পার হয়েচে সে— একা। মরে গিয়ে চিমানিমানি পর্ব্বতের শিলায় নাম খুদে রেখে যাবে। সে একজন বিশিষ্ট ভ্রমণকারী ও আবিষ্কারক। অত বড় হীরের খনি সেই তো খুঁজে বার করেছে! আলভারেজ মারা যাওয়ার পরে সেই বিশাল অরণ্য ও পার্ব্বত্য অঞ্চলের গোলকধাঁধা থেকে সে তো একাই বার হতে পেরে এতদূর এসেচে! এখন সে নিরুপায়, অসুস্থ, চলত্শক্তি রহিত। তবুও সে যুঝচে, ভয় তো পায়নি, সাহস তো হারায়নি। কাপুরুষ, ভীরু নয় সে। জীবন-মৃত্যু তো অদৃষ্টের খেলা। না বাঁচলে তার দোষ কি?
দীর্ঘ রাত্রি কেটে গিয়ে পুবদিক ফরসা হোল। সঙ্গে সঙ্গে বন্য জন্তুর দল কোথায় পালালো। বেলা বাড়চে, আবার নির্ম্মম সূর্য্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে সুরু করেচে দিকবিদিক। সঙ্গে সঙ্গে শকুনির দল কোথা থেকে এসে হাজির। কেউ মাথার ওপর ঘুরচে, কেউ বা দূরে দূরে গাছের ডালে কি পাথরের ওপরে বসে খুব ধীরভাবে প্রতীক্ষা করচে। ওরা যেন বলচে— কোথায় যাবে বাছাধন? যে কদিন লাফালাফি করবে, করে নাও। আমরা বসি, এমন কিছু তাড়াতাড়ি নেই আমাদের।
শঙ্করের খিদে নেই। খাবার ইচ্ছেও নেই। তবুও সে গুলি করে একটা শকুনি মারলে। রৌদ্র ভীষণ চড়েচে, আগুন-তাতা পাথরের গায়ে পা রাখা যায় না। এ পর্ব্বতও মরুভূমির সামিল, খাদ্য এখানে মেলে না, জলও না। সে মরা শকুনিটা নিয়ে এসে আগুন জ্বেলে ঝলসাতে বসলো। এর আগে মরুভূমির মধ্যেও সে শকুনির মাংস খেয়েচে। এরাই এখন প্রাণ ধারণের একমাত্র উপায়, আজ ও খাচ্চে ওদের, কাল ওরা খাবে ওকে। শকুনিগুলো এসে আবার মাথার উপর জুটেচে।
তার নিজের ছায়া পড়েচে পাথরের গায়ে, সে নির্জ্জন স্থানে শঙ্করের উদ্ভ্রান্ত মনে ছায়াটা যেন একজন সঙ্গী মনে হোল। বোধহয়, ওর মাথা খারাপ হয়ে আসচে। কারণ বেঘোর অবস্থায়, ও কত বার নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো, কতবার পরক্ষণের সচেতন মুহূর্ত্তে নিজের ভুল বুঝে নিজেকে সামলে নিলে।
সে পাগল হয়ে যাচ্চে নাকি? জ্বর হয়নি তো? তার মাথার মধ্যে ক্রমশঃ গোলমাল হয়ে যাচ্চে সব। আলভারেজ… হীরের খনি… পাহাড়, পাহাড়, বালির সমুদ্র… আত্তিলিও গাত্তি। কাল রাত্রে ঘুম হয়নি … আবার রাত আসচে, সে একটু ঘুমিয়ে নেবে।
কিসের শব্দে ওর তন্দ্রা ছুটে গেল। একটা অদ্ভুত ধরনের শব্দ আসচে কোনদিক থেকে? কোন পরিচিত শব্দের মত নয়। কিসের শব্দ? কোনদিক থেকে শব্দটা আসচে তাও বোঝা যায় না। কিন্তু ক্রমশঃ কাছে আসচে সেটা।
হঠাৎ আকাশের দিকে শঙ্করের চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তার মাথার ওপর দিয়ে বিকট শব্দ করে কী একটা জিনিস যাচ্চে। ওই কি এরোপ্লেন? সে বইয়ে ছবি দেখেছে বটে।
এরোপ্লেন যখন ঠিক মাথার ওপর এল, শঙ্কর চীৎকার করলে, কাপড় ওড়ালে, গাছের ডাল ভেঙে নাড়লে, কিন্তু কিছুতেই পাইলটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে না। দেখতে দেখতে এরোপ্লেনখানা সুদূরে ভায়োলেট রঙের পল ক্রুগার পর্ব্বতমালার মাথার ওপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
হয়তো আরও এরোপ্লেন যাবে এ পথ দিয়ে। কী আশ্চর্য্য দেখতে এই এরোপ্লেন জিনিসটা। ভারতবর্ষে থাকতে সে একখানাও দেখেনি।
শঙ্কর ভাবলে আগুন জ্বালিয়ে কাঁচা ডাল পাতা দিয়ে সে যথেষ্ট ধোঁয়া করবে। যদি আবার এ পথে যায়, পাইলটের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে ধোঁয়া দেখে। একটা সুবিধে হয়েচে, এরোপ্লেনের ঐ বিকট আওয়াজে শকুনির দল কোনদিকে ভেগেচে যেন।
সেদিন কাটল। দিন কেটে রাত্রি হবার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের দুর্ভোগ হল সুরু। আবার গত রাত্রির পুনরাবৃত্তি। সেই কোয়োটের দল আবার এল। আগুনের চারধারে তারা আবার তাকে ঘিরে বসলো। নেকড়ে বাঘটা সন্ধ্যা না হতেই দূর থেকে একবার দেখে গেল। গভীর রাত্রে আর একবার এল।
কিসে এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়? আওয়াজ করতে ভরসা হয় না— টোটা মাত্র দুটী বাকী। টোটা ফুরিয়ে গেলে তাকে অনাহারে মরতে হবে। মরতে তো হবেই, তবে দু’দিন আগে আর পিছে; যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
কিন্তু আওয়াজ তাকে করতেই হোল। গভীর রাত্রে হায়েনাগুলো এসে কোয়োটদের সাহস বাড়িয়ে দিলে। তারা আরও এগিয়ে সরে এসে তাকে চারি ধার থেকে ঘিরলে। পোড়া কাঠ ছুঁড়ে মারলে আর ভয় পায় না।
একবার একটু তন্দ্রামত এসেছিল— বসে বসেই ঢুলে পড়েছিল। পর মুহূর্ত্তে সজাগ হয়ে উঠে দেখলে, নেকড়ে বাঘটা অন্ধকার থেকে পা টিপে টিপে তার অত্যন্ত কাছে এসে পড়েচে। ওর ভয় হোল, হয়তো ওটা ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভয়ের চোটে একবার গুলি ছুঁড়লে। আরেকবার শেষ রাত্রের দিকে ঠিক এ রকমই হোল। কোয়োটগুলোর ধৈর্য্য অসীম, সেগুলো চুপ করে বসে থাকে মাত্র, কিছু বলে না! কিন্তু নেকড়ে বাঘটা ফাঁক খুঁজচে।
রাত ফর্সা হবার সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্নের মতো অন্তর্হিত হয়ে গেল কোয়োট, হায়েনা ও নেকড়ের দল। সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করও আগুনের ধারে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
একটা কিসের শব্দে শঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল।
খানিকটা আগে খুব বড় একটা আওয়াজ হয়েচে কোনো কিছুর। শঙ্করের কাণে তার রেশ এখনও লেগে আছে।
কেউ কি বন্দুকের আওয়াজ করেচে? কিন্তু তা অসম্ভব, এই দুর্গম পর্ব্বতের পথে কোন মানুষ আসবে?
একটী মাত্র টোটা অবশিষ্ট আছে। শঙ্কর ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে, সেটা খরচ করে একটা আওয়াজ করলে। যা থাকে কপালে, মরেচেই তো। উত্তরে দু’বার বন্দুকের আওয়াজ হোল।
আনন্দে ও উত্তেজনায় শঙ্কর ভুলে গেল যে তার পা খোঁড়া, ভুলে গেল যে সে একটানা বেশীদূর যেতে পারে না। তার আর টোটা নেই, সে আর বন্দুকের আওয়াজ করতে পারলে না কিন্তু প্রাণপণে চীৎকার করতে লাগলো। গাছের ডাল ভেঙে নাড়তে লাগলো, আগুন জ্বালবার কাঠকুটোর সন্ধানে চারিদিকে আকুল-দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে লাগলো।
ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক জরীপ করবার দল, কিম্বার্লি থেকে কেপটাউন যাবার পথে, চিমানিমানি পর্ব্বতের নীচে কালাহারি মরুভূমির উত্তর-পূর্ব্ব কোণে তাঁবু ফেলেছিল। সঙ্গে সাতখানা ডবল টায়ার ক্যাটারপিলার চাকা বসানো মোটর গাড়ী, এদের দলে নিগ্রো কুলী ও চাকর-বাকর বাদে ন’জন ইউরোপীয়। জন চারেক হরিণ শিকার করতে উঠেছিল চিমানিমানি পর্ব্বতের প্রথম ও নিম্নতম থাকটাতে।
হঠাৎ এ জনহীন অরণ্যপ্রদেশে সভ্য রাইফেলের আওয়াজে ওরা বিস্মিত হয়ে উঠল। কিন্তু ওদের পুনরায় আওয়াজের প্রত্যুত্তর না পেয়ে ইতস্ততঃ খুঁজতে বেরিয়ে দেখতে পেলে, সামনে একটা অপেক্ষাকৃত উচ্চতর চূড়া থেকে, এক জীর্ণ ও কঙ্কালসার কোটরগতচক্ষু প্রেতমূর্ত্তি উন্মাদের মত হাত-পা নেড়ে তাদের কি বোঝাবার চেষ্টা করচে। তার পরনে ছিন্নভিন্ন অতি মলিন ইউরোপীয় পরিচ্ছদ।
ওরা ছুটে গেল। শঙ্কর আবোল-তাবোল কি বকল, ওরা ভালো বুঝতে পারলে না। যত্ন করে নামিয়ে পাহাড়ের নীচে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল। ওর জিনিসপত্রও নামিয়ে আনা হয়েছিল। ওকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হোল।
কিন্তু এই ধাক্কায় শঙ্করকে বেশ ভুগতে হোল। ক্রমাগত অনাহারে, কষ্টে, উদ্বেগে, অখাদ্য-কুখাদ্য ভক্ষণের ফলে, তার শরীর খুব যখম হয়েছিল, সেই রাত্রেই তার বেজায় জ্বর এল।