ছেলেবেলা/১০

উইকিসংকলন থেকে

১০

ছাদের রাজ্যে নতুন হাওয়া বইল, নামল নতুন ঋতু।

 তখন পিতৃদেব জোড়াসাঁকোয় বাস ছেড়েছিলেন। জ্যোতিদাদা এসে বসলেন বাইরের তেতলার ঘরে। আমি একটু জায়গা নিলুম তারই একটি কোণে।

 অন্দরমহলের পর্দা রইল না। আজ এ কথা নতুন ঠেকবে না, কিন্তু তখন এত নতুন ছিল যে মেপে দেখলে তার থই পাওয়া যায় না। তারও অনেককাল আগে, আমি তখন শিশু, মেজদাদা সিভিলিয়ন হয়ে দেশে ফিরেছেন। বােম্বাইয়ে প্রথম তাঁর কাজে যােগ দিতে যাবার সময় বাইরের লােকদের অবাক করে দিয়ে তাদের চোখের সামনে দিয়ে বউঠাকরুনকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। বাড়ির বউকে পরিবারের মধ্যে না রেখে দূর বিদেশে নিয়ে যাওয়া এই তাে ছিল যথেষ্ট, তার উপরে যাবার পথে ঢাকাঢাকি নেই— এ যে হল বিষম বেদস্তুর। আপন লোকদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

 বাইরে বেরােবার মতাে কাপড় তখনাে মেয়েদের মধ্যে চলতি হয় নি। এখন শাড়ি জামা নিয়ে যে সাজের চলন হয়েছে, তারই প্রথম শুরু করেছিলেন বউঠাকরুন।

 বেণী দুলিয়ে তখনাে ফ্রক ধরে নি ছােটো মেয়েরা— অন্তত আমাদের বাড়িতে। ছােটোদের মধ্যে চলন ছিল পেশােয়াজের। বেথুন ইস্কুল যখন প্রথম খােলা হল, আমার বড়দিদির ছিল অল্প বয়স। সেখানে মেয়েদের পড়াশােনার পথ সহজ করবার প্রথম দলের ছিলেন তিনি! ধব্‌ধবে তাঁর রঙ। এ দেশে তাঁর তুলনা পাওয়া যেত না। শুনেছি পাল্কিতে করে স্কুলে যাবার সময় পেশােয়াজ-পরা তাঁকে চুরি করা ইংরেজ মেয়ে মনে করে পুলিসে একবার ধরেছিল।

 আগেই বলেছি সেকালে বড়াে-ছোটোর মধ্যে চলাচলের সাঁকোটা ছিল না। কিন্তু এই-সকল পুরােনাে কায়দার ভিড়ের মধ্যে জ্যোতিদাদা এসেছিলেন নির্জলা নতুন মন নিয়ে। আমি ছিলুম তাঁর চেয়ে বারাে বছরের ছােটো। বয়সের এত দূর থেকে আমি যে তাঁর চোখে পড়তুম, এই আশ্চর্য। আরাে আশ্চর্য এই যে, তাঁর সঙ্গে আলাপে জ্যাঠামি ব’লে কখনাে আমার মুখ চাপা দেন নি। তাই কোনাে কথা ভাবতে আমার সাহসে অকুলােন হয় নি। আজ ছেলেদের মধ্যেই আমার বাস। পাঁচ-রকম কথা পাড়ি, দেখি তাদের মুখ বােজা। জিজ্ঞেসা করতে এদের বাধে। বুঝতে পারি এরা সব সেই বুড়ােদের কালের ছেলে যে কালে বড়ােরা কইত কথা আর ছােটোরা থাকত বােবা। জিজ্ঞাসা করবার সাহস নতুন কালের ছেলেদের; আর বুড়ােকালের ছেলেরা সব-কিছু মেনে নেয় ঘাড় গুঁজে।

 ছাদের ঘরে এল পিয়ানাে। আর এল একালের বার্নিশ করা বউবাজারের আসবাব। বুকের ছাতি উঠল ফুলে। গরিবের চোখে দেখা দিল হাল আমলের সস্তা আমিরি।

 এইবার ছুটল আমার গানের ফোয়ারা। জ্যোতিদাদা পিয়ানাের উপর হাত চালিয়ে নতুন নতুন ভঙ্গিতে ঝমাঝম্ সুর তৈরি করে যেতেন; আমাকে রাখতেন পাশে। তখনই-তখনই সেই ছুটে-চলা সুরে কথা বসিয়ে বেঁধে রাখবার কাজ ছিল আমার।

 দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর আর তাকিয়া। একটা রুপাের রেকাবিতে বেলফুলের গােড়েমালা ভিজে রুমালে, পিরিচে এক-গ্লাস বরফ-দেওয়া জল, আর বাটাতে ছাঁচিপান।

 বউঠাকরুন গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা; বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান। গলায় যেটুকু সুর দিয়েছিলেন বিধাতা তখনাে তা ফিরিয়ে নেন নি। সূর্য-ডােবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত আমার গান। হু হু ক’রে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভ’রে।

 ছাদটাকে বউঠাকরুন একেবারে বাগান বানিয়ে তুলেছিলেন। পিল্পের উপরে সারি সারি লম্বা পাম গাছ; আশেপাশে চামেলি, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা। ছাদ-জখমের কথা মনেই আনেন নি, সবাই ছিলেন খেয়ালি।

 প্রায় আসতেন অক্ষয় চৌধুরী। তাঁর গলায় সুর ছিল না সে কথা তিনিও জানতেন, অন্যেরা আরাে বেশি জানত। কিন্তু তাঁর গাবার জেদ কিছুতে থামত না। বিশেষ করে বেহাগ রাগিণীতে ছিল তাঁর শখ। চোখ বুজে গাইতেন, যারা শুনত তাদের মুখের ভাব দেখতে পেতেন না। হাতের কাছে আওয়াজওয়ালা কিছু পেলেই দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে পটাপট্ শব্দে তাকেই বাঁয়া-তবলার বদলি করে নিতেন। মলাট বাঁধানাে বই থাকলে ভালােই চলত। ভাবে ভাের মানুষ; তাঁর ছুটির দিনের সঙ্গে কাজের দিনের তফাত বােঝা যেত না।

 সন্ধেবেলার সভা যেত ভেঙে। আমি চিরকাল ছিলুম রাত জাগিয়ে ছেলে। সকলে শুতে যেত, আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াতুম ব্রহ্মদত্তির চেলা। সমস্ত পাড়া চুপচাপ। চাঁদনি রাতে ছাদের উপর সারি সারি গাছের ছায়া যেন স্বপ্নের আলপনা। ছাদের বাইরে সিসু গাছের মাথাটা বাতাসে দুলে উঠছে, ঝিল্‌মিল্‌ করছে পাতাগুলাে। জানি নে কেন সব চেয়ে চোখে পড়ত সামনের গলির ঘুমন্ত বাড়ির ছাদে একটা ঢালু-পিঠ-ওয়ালা বেঁটে চিলেকোঠা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিসের দিকে যেন আঙুল বাড়িয়ে রয়েছে।

 রাত একটা হয়, দুটো হয়। সামনের বড়াে রাস্তায় রব ওঠে—

‘বলাে হরি! হবিবােল!’