তামাকের দোষ গুণ ও ইতিহাস/দ্বিতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে


দ্বিতীয় অধ্যায়।


ইতিহাস।

 ১৪৯২ খৃঃ অব্দের নবেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউরোপীয়েরাই তামাকের বিষয় প্রথম অবগত হন। সুপ্রসিদ্ধ কলম্বস নাবিক যখন রত্নগর্ভা ভারতভূমির পথ আবিস্কারার্থ অপার জলধিজলে তরণী ভাসাইয়া কৌতূহলাক্রান্ত মনে আটলাণ্টিক মহাসাগর দিয়া গমন করিতেছিলেন, সেই সময়ে স্বীয় সহচরদ্বয়কে কিউবা দ্বীপ আবিষ্কার করিতে প্রেরণ করেন। নাবিকদ্বয় যখন কিউবায় উপনীত হন, তখন তাঁহারা দেখিলেন যে কতিপয় লোক একত্র সমবেত হইয়া বসিয়া আছেন; আর তাঁহাদের মুখ ও নাসিক হইতে অনবরত ধূম বিনির্গত হইতেছে। নাবিকদ্বয় এই অভূতপূর্ব্ব ব্যাপার দর্শন করিয়া প্রথমে অতিশয় আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলেন। তৎপরে তাঁহারা বিবেচনা করেন যে, উহার স্ব স্ব দেহ সুবাসিত করিবার অভিপ্রায়ে এই প্রকার ধূম সেবন করিতেছে।

 কিউবাবাসীরা নাবিকদ্বয়ের আগমন বৃত্তান্ত অবগত হইবার পরে আপনাদিগের ধূম পানের বিষয় তাঁহাদিগকে এই প্রকার পরিচয় দেন যে, আমরা এক প্রকার গাছের পত্র শুষ্ক ও অগ্নিতে সংলগ্ন করিয় তাহার ধূম সেবন করিয়া থাকি। এই ধূমপানের দ্বারা আমাদের দৈহিক ও মানসিক ক্লেশের অনেক শান্তি হয়। ইউরোপীয়েরা তামাকের বিষয় এই প্রথম অবগত হইলেন। এই ঘটনার কিছু দিবস পরেই আমেরিকf ও উক্ত কিউবা দ্বীপ বাসীগণ তাম্রকূট সেবনের এক প্রকার যন্ত্রের আবিষ্কার করেন। একটি ত্রিমুখ যুক্ত নলের এক প্রান্তভাগে তামাক গুঁড়া করিয়া সাজিত ও অপর প্রান্তদ্বয় নাসিকার গহ্বর মধ্যে প্রবিষ্ট করিয়া দিয়া ধূম গ্রহণ করিত। গৃহীত ধূম, মুখ দ্বার বহির্গত করিয়া ফেলিত।

 ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রানসে, সাহারাণ্ডেজ নামক একজন স্পেনীয় ডাক্তার, স্পেনাধিপতি দ্বিতীয় ফিলিপকে দেখাইবার জন্য ইউরোপের মধ্যে, প্রথম তামাক আনয়ন করেন। ফিলিপ কি প্রকারে তামাক উৎপন্ন করিতে হয়, জানিয়া আসিবার জন্য পুনরায় উক্ত ডাক্তারকে মেক্সিকো প্রদেশে পাঠাইয়া ছিলেন। ১৫৬১ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রানস দেশে নাইকট্ নামক এক ব্যক্তি, রাণী ক্যাথারাইনকে এই পদার্থ উপহার দেন। বোধ হয় এই জন্যই তামকের তৈলাক্ত বিষের নাম নিকোটাইন হইয়াছে। প্রথমে যে স্থানে তামাক উৎপন্ন হইয়াছিল, তাহার নাম টোবাকো। সেই জন্যই স্পেনের লোকের ইহার নাম টোবাকো রাখেন। পূর্ব্বে কিউবাবাসীরা যে ত্রিমুখ নলে তামাক খাইতেন, তাহার নাম টোবাকো, বোধ হয় সেই জন্য ইহার নাম টাবাকু হইয়া থাকিবে। পর্ত্তুগাল ও ইটালির লোকেরা ইহার নাম টবাক্কো রাখিয়াছেন। পোলণ্ডবাসীরা ট্যাবাক্ কহিয়া থাকেন। ওলন্দাজ এবং সুইডেনবাসীরা টোবাক্ কহেন। ফ্রান্‌স দেশে ট্যাবাক্ নামে অভিহিত।

 সার্ ওয়াল্টার রালে, মিষ্টার রালফলেন নামক একজনকে, শাসনকর্ত্তা করিয়া ভর্জ্জিনিয়ায় পাঠাইয়া ছিলেন। ইংলণ্ডবাসীদিগের মধ্যে এই মহাত্মাই প্রথম ধূমপান করিতে অভ্যাস করেন। কাহার কাহারও মতে কুইন এলিজাবেথের সময় ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ইংলণ্ডে প্রথম তামাক আসিয়াছিল। কেহ কেহ বলেন ১৫৭৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংলণ্ডে তামাক আনীত হয়। স্যার্ ওয়াল্টার রালে, তামাক সেবনের উৎকৃষ্টতর পদ্ধতির আবিষ্কার করিয়া ছিলেন। এই সময়ের ১০ বৎসর পরে ইংলণ্ডের কতিপয় সমালোচক ব্যক্তি তাম্রকূট সেবনের প্রথা দেশ মধ্যে পরিব্যাপ্ত হইতেছে দেখিয়া নানাপ্রকার আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলেম। কিন্তু তাঁহাদের সে আপত্তি ফলোপধানে সমর্থ হয় নাই। কারণ তামাক তখন ইংলণ্ডের সভ্যসম্প্রদায়ের এমন অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল যে, তাঁহারা আর তাহা কোন মতে পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হইলেন না। ধূমপান তখন ভদ্র-ব্যবহারের একটা চিহ্ন স্বরূপ হইয়াছিল। এমন কি, তখনকার ভদ্র লোকেরা ধূমপান অভ্যাস করিবার জন্য স্বতন্ত্র বাঢ়ী ভাড়া লইতেন। ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত ইউরোপ খণ্ডে অধিক পরিমাণে ইহার উন্নতি হইয়াছিল। তৎসমকালীন কবিগণ স্ব স্ব প্রণীত কাব্যে এবং সাময়িক পত্র সমূহে ইহার যশ এত ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, একজন শাসনকর্ত্তার মানের সহিত ইহার মান সমান হইয়াছিল।

 ১৬০২ খৃঃ অব্দে তামাকের বিষয়ে একখানি কাব্য প্রকাশিত হয়। উহার প্রণেতার নাম উল্লেখ নাই বটে, কিন্তু পুস্তকখানি ইংলণ্ডের একজন প্রসিদ্ধ কবি মিচলড্রে টনকে উপহার দেওয়া হয়। ঐ কাব্যে লিখিত আছে যে, “কোন সময়ে পঞ্চভূতের সভা সংস্থাপিত হয়। প্রমিথিয়স নামক দেবতা উক্ত সভায় এই প্রকার বলেন যে, পৃথিবীর সৃষ্টি এখনও সম্পূর্ণ হয় নাই। ইহাতে এমন এক প্রকার গাছ উৎপন্ন হইবে যে, তাহার ধূমে মৃতব্যক্তিও কিছুক্ষণ চৈতন্য লাভ করিবে। পঞ্চভূত কর্ত্তৃক এই তামাকের গাছ সৃষ্ট হইয়াছিল। জুপিটার দেবতা এই তামাকের গাছ দেখিয়া অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হইয়াছিলেন। সেই সময়ে ক্রোধান্বিত জুপিটর এই অভিসম্পাত প্রদান করেন যে, সমস্ত ইউরোপ খণ্ড ও ইহার পরিচিত যে সকল দেশ আছে, সে সমস্ত দেশেই যেন ইহার চাষ না হয়। সেই জন্যই যতদিন আমেরিকা আবিষ্কার না হইয়াছিল, ততদিন ইহার প্রচলন স্থগিত ছিল।”

 পারস্য দেশে বহুকাল অবধি তামাক প্রস্তুত করিবার উৎকৃষ্ট প্রণালী প্রচলিত ছিল। সেই জন্যই কেহ কেহ বিবেচনা করেন যে, পূর্ব্বাঞ্চলেই ইহার প্রথম উৎপত্তি হইয়াছিল। আমেরিকা হইতে এদেশে তামাক আনীত হইবার পূর্ব্বে এতদ্দেশে ইহা প্রচলিত ছিল কি না ইহা লইয়া অনেকে বাদানুবাদ করিয়া থাকেন। কেহ কেহ বলেন, ইউরোপ খণ্ডে তামাক আনীত হইবার পূর্ব্বে, এমন কোন পুস্তক দেখা যায় না যাহাতে তামাকের নাম উল্লেখ আছে। বেল সাহেব বলেন যে, চীনবাসীরা কহিয়া থাকে তাহাদের দেশে বহুকাল হইতে ধূমপানের প্রথা প্রচলিত আছে। আমরা বোধ করি যে, বেল্ সাহেবের ভ্রম হইয়া থাকিবে। না হয় তিনি যাঁহার মুখে শুনিয়াছেন, তাঁহার ভ্রম হইয়া থাকবে। কারণ চীন ইতিহাস পাঠে আমরা অবগত হইয়াছি যে, তাঁহাদের দেশে বহুকাল হইতে ধূমপানের প্রথা প্রচলিত আছে সত্য, কিন্তু তাহা যে, তামাকের ধূম তাহার কোন প্রমাণ নাই। বোধ হয় গাঁজা প্রভৃতি মাদক দ্রব্যের ধূম হইবে। চীনবাদীরা যে ভারতবর্ষ হইতে তামাক লইয়া গিয়াছিল, তাহার প্রমাণ আমরা অনেক স্থানে পাইয়াছি।

 অসামান্য রূপমাধুরিসম্পন্না সুবিখ্যাতা নূরজাহানের হৃদয়নাথ জাহাঙ্গির যখন দিল্লির সিংহাসনে আধিপত্য করিতেছিলেন, সেই সময়ে অর্থাৎ ১৬৯৯ খ্রীষ্টাব্দে বাণিজ্যপ্রিয় পর্তুগালবাসীরা ভারতভূমিতে তামাক আনয়ন করেন। এই সময়ের ৩০ বৎসর পূর্ব্বে পর্ত্তুগালবাসীরা পারস্য উপসাগরের দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্যকার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন। এই সময়ে পারস্য দেশে তামাক প্রচলিত হইয়াছিল। কোন কোন ব্যক্তি কহেন, পর্ত্তুগালের লোকেরা ভারতবর্ষ হইতে অন্যান্য বাণিজ্য দ্রব্যের সহিত তামাকও বহুপরিমাণে ক্রয় করিয়া পারস্যবাসীদিগকে বিক্রয় করিত।

 তুরস্কবাসীর পারস্যদেশ হইতে তাম্রকূট ক্রয় করিয়া, সেবন করিতেন। আবার কেহ কেহ বলেন যে, তুরস্কবাসীরাও ভারতবর্ষ হইতে তামাক ক্রয় করিয়া লইয়া যাইতেন। স্যার টমাস হারবট কহেন যে “আমি এক দিবস দেখিলাম বোগদাদের সরাইতে বৈকালে বহুসংখ্যক লোক সমবেত হইয়া ধূমপান করিতেছে। শ্রুত হইলাম তাহারা প্রত্যহ বৈকালে এই প্রকার ধুমপান করিয়া থাকে।”

 স্যাণ্ডিস্ সাহেব ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দে কন্‌ষ্টাণ্টিনোপলে অবস্থিতি করিয়াছিলেন। তিনিও কহেন, আমি এই প্রথম তুরস্কবাসীদিগের তামাক সেবন অভ্যাস হইতেছে দেখিলাম। ইহা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দেই তুরস্ক দেশে তামাক প্রচলিত হইয়াছিল। স্যাণ্ডিস সাহেব এ কথাও বলেন যে, ইংরেজেরাই ইহাদিগকে প্রথম তামাক সেবন করিতে অভ্যাস করাইয়াছিলেন।