তারাচরিত/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বিবাহের কয়েক দিবস পরে নব দম্পতীর মিওয়ারে যাইবার কথা রায় সুরতনের নিকট প্রস্তাবিত হইল। ঐ প্রস্তাবে তিনি নিস্তব্ধ হইয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে পৃথ্বীরাজকে বলিলেন, বৎস তুমি তোমার দেশে যাইবে তাহাতে আমার কোন আপত্তি নাই; কিন্তু বৎস আমি তারাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া থাকিব বল। রাজা এই রূপ কত কথাই বলিলেন। পরিশেষে অগত্যা তাঁহাকে অনুমতি দিতে হইল। এদিকে যাইবার সকল উদযোগ হইতেছে শুনিয়া পিতৃবৎসলা তারা একেবারে চিন্তা সাগরে নিমগ্ন হইলেন,এবং বলিতে লাগিলেন, আমি কেমন করিয়া পিতাকে ছাড়িয়া যাইব; আমি যে কখন পিতাকে ছড়িয়া কোথাও যাই নাই; উঃ হৃদয় যে কোন মতে প্রবোধ মানিতেছে না! কি করি, হা বিধাতঃ তোমার মনে কি এই ছিল। এই রূপ বলিতে বলিতে তারার মাতাকে মনে পড়িয়া গেল। তখন তিনি মাতৃ সম্বোধনে বলিতে লাগিলেন, হা মাতঃ তুমি যদি আমাদের ছাড়িয়া অকালে না যাইতে তাহা হইলে আজ কি সুখেরি দিন হইত। আমি এখন পিতাকে কাহার নিকট সমর্পণ করিয়া যাই। কাহারও কাছে রাখিয়া এক দণ্ড সুখী হইতে পারিব না। রে হৃদয় তুমি দ্বিধা বিভিন্ন হও, তাহা হইলে আমি সকল দিকে রক্ষা পাই। এই কথা বলিতে বলিতে আবার ভাবিলেন, আমি কি কঠিন, কেমন করিয়া প্রাণনাথকে ছাড়িতে চাহিতেছি। তারা এইরূপ পিতৃচিন্তাতে নিমগ্ন আছেন এমন সময় পৃথ্বীরাজ আসিয়া বলিলেন প্রিয়ে তোমার বদন সুধাকর রাহুগ্রস্ত দেখিতেছি কেন? যেমন নীল নভোমণ্ডল মেঘাচ্ছন্ন হইলে পূর্ণ সুধাকর লয়প্রাপ্ত হইয়া যায়, অদ্য তোমাকে তেমনি দেখিতেছি কেন? আমার কি কোন অজ্ঞাত অপরাধ হইয়াছে? বল বল, তোমার মুখ দেখিয়া আমার হৃদয় আন্দোলিত হইতেছে। এইরূপ কাতরোক্তি শ্রবণ করিয়া তারা বলিলেন, নাথ এত উতলা হইতেছ কেন? তুমি আমার নিকট কি অপরাধ করিবে বল? আমি হইলাম নীচ নারী জাতি, তুমি হইলে উত্তম পুরুষ। আমার আর কিছু ভাবনা হইতেছে না। বলিতে কি নাথ আমার হর্ষে বিষাদ উপস্থিত হইতেছে। বিষাদ এই যে, আমি আমার পিতাকে ছাড়িয়া দীর্ঘকাল কখন কোথাও যাই নাই। কেমন করিয়া তার বিরহ সহ্য করিব, এই ভাবিয়া আমার মন এত উৎকণ্ঠিত হইতেছে। পৃথ্বীরাজ কহিলেন তোমার ভাবনা কি? তিনি ত তোমার মত কোমলান্তঃকরণ স্ত্রী নহেন যে, তোমার মত অধীর হইবেন। পৃথ্বীরাজ তারাকে এইরূপ বুঝাইয়া কহিলেন, এখন আর বিলম্বের প্রয়োজন নাই, চল যাত্রার সকলি প্রস্তুত প্রায়।
এদিকে রাজা সুরতন্ কন্যার যাইবার উপযোগী সকল সামগ্রীই আয়োজন করিয়া দিলেন এবং যানাদি সকল সাজান হইল দেখিয়া মালতী তাড়া তাড়ি তারার মন্দিরে আসিয়া দেখিলেন সখী সজল নয়নে করতলে কপোল বিন্যস্ত করিয়া অশ্রুবর্ষণ করিতেছেন। দেখিয়া মালতী জিজ্ঞাসা করিলেন সখি অদ্য এ ভাবাপন্ন দেখিতেছি কেন? শুনিয়া তারা হূ হূ করিয়া কাঁদিয়া মালতীর গলদেশে তার সুধাকর বিনিন্দিত বদনমণ্ডল রাখিয়া বলিলেন, প্রাণ প্রতিমে অদ্য আমি তোমাদিগকে ছাড়িয়া চলিলাম, সখি আমাকে জন্মের মতন বিদায় দাও, আর অদ্যাবধি আমার নিমিত্ত তোমাকে কষ্ট করিতে হইবে না। প্রিয়সখি তোমার স্নেহ বিগলিত বাক্য সকল আমি কেমন করিয়া বিস্মৃত হইব! আমার নিমিত্ত তুমি যে কত কষ্ট স্বীকার করিয়াছ তাহা এক মুখে বলিতে পালি না। সজনি তোমাকে আমি ভুলিতে পারিব না, কিন্তু সখি তুমি আমাকে ভুলিয়া যাইবে, কারণ আমা হইতে তোমার কোন উপকার হইল না, কেবল আমি তোমাকে আমার বিপদের ভাগীই করিলাম। এই বলিতে বলিতে তারার নয়ন যুগল হইতে দরদরিত অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল। পরিশেষে তারা অতি কষ্টে রোদনের বেগ সম্বরণ করিয়া মালতীর হাত ধরিয়া বলিলেন সখি আমার একটা শেষ অনুরোধ রক্ষা করিতে হইবে; সখি আমি অদ্য হইতে তোমার নিকট পিতাকে সমর্পণ করিলাম, যে পর্য্যন্ত আমি প্রত্যাগমন না করি সেই পর্যন্ত তুমি আমার স্থানীয় হইয়া পিতার পরিচর্যা কর। এই কথা শুনিবামাত্র মালতীর কোমল গণ্ডস্থল বহিয়া অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল। তিনি বলিলেন সখি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় যাইবে! আমি কেমন করিয়া তোমার বিচ্ছেদে প্রাণ ধারণ করিব! তোমার শারদীয় চন্দ্রসম বদন শোভা আমি যে এক ক্ষণ না দেখিয়া থাকিতে পারি না। উঃ! সখিরে আমি কেমন করিয়া প্রাণ থাকিতে তোমার বিচ্ছেদ সহ্য করিব বল। সজনি আমি যে কোনরূপ মনঃকষ্ট পাইলে তোমার নিকট জুড়াইতাম, অদ্য আমি যেই বিশ্রাম স্থল কোথায় করিব। তোমার নিমিত্ত রাজবাড়ী অন্ধকার হইবে। তোমার স্নেহ বিগলিত বচন আমি শুনিয়া যে কর্ণকুহর পরিতৃপ্ত করিতাম; হায় অদ্য আর সেই সুধা, মাপ কথা যে শুনিতে পাইব না! সখি অদ্যাবধি আমরা হৃদয়ান্ধকারে কেমন করিয়া থাকিব! এই রূপে মালতী সকরুণ স্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন। তারার যাইবার সকল উদ্যোগ হইয়াছে দেখিয়া মহারাজ সুরতন্ বলিলেন বৎসে মালতী আর বিলম্বের প্রয়োজন নাই তারাকে যানারোহণ করাইয়া দাও। এই কথা শুনিবামাত্র তারা ছিন্নমূল তরুর ন্যায় সেই স্থানে ধূলিতে লুণ্ঠিত হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। মহারাজ তারাকে কহিলেন উঠ উঠ বৎসে আর কেন রোদন করিতেছ, আমি মাসে দুই তিন বার তোমাকে যাইয়। দেখিয়া আসিব। রাজা এই প্রকার কত মতে বুঝাইয়া তারাকে তথা হইতে উঠাইলেন। তাহার পর তারা এক জন বৃদ্ধ পরিচারিকাকে বলিলেন মাতঃ আমি আমার হৃদয় রত্ন মালতীকে তোমাকে সমর্পণ করিলাম, অদ্যাবধি ইনি আমার স্থানীয় হইলেন। এই বলিয়া তারা মালতীকে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া যানারোহণ করিলেন।
যাইতে যাইতে পথিমধ্যে তাঁহারা মনোহর দৃশ্য সকল দর্শন করিতে লাগিলেন। পৃথ্বীরাজ বলিলেন দেখ দেখ প্রেয়সি কেমন বনরাজি সকল সাজিয়া জগতের সৌন্দর্য্য সম্পাদন করিতেছে; ঐ দেখ করিকুল যূথবদ্ধ হইয়া ভ্রমণ করিতেছে; ঐ দেখ মৃগ সকল লম্ফ প্রদান করিয়া মৃগীকে পশ্চাৎ রাখিয়। ধাবমান হইতেছে; বৃক্ষ হইতে পক্ষী সকল বৃক্ষান্তরে উড়িয়া যাইতেছে এবং চঞ্চু দ্বারা স্বীয় শাবককে আহার প্রদান করিতেছে; ঐ দেখ কোকিল কোকিল একত্রে বসিয়া কেমন বিশ্ব রাজ্যের প্রণয় সম্পাদন করিতেছে; চাতক চাতকিনী নবধনকে না দেখিতে পাইয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতেছে; দেখ দিবস “অত্যন্ত গভীর ভাব অবলম্বন করিয়াছে; নিদাঘ সময়ের কোলাহল আর কিছুই এত হইতেছে না; কাক সকল ককশ রবে বিরত হইয়া অটবির ঘন শাখায় বসিয়া চতুর্দ্দিক অবলোকন করিতেছে। এস আমরাও এই সময়ে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করি। এই বলিয়া পৃথ্বীরাজ বাহকদিগকে এবং অন্য অন্য সমভিব্যাহারিবর্গকে বিশ্রাম করিতে অনুমতি করিলেন। সকলে সন্নিহিত এক আম্র কাননে শ্রমাপনয়ন করিতে লাগিলেন।
দিবসের পরিণাম উপস্থিত হইল। সকলে পুনর্ব্বার গাত্রোত্থান করিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিলে পর পৃথ্বীরাজ তারাকে সঙ্গোপন করিয়া বলিলেন, প্রেয়সি দেখ দিবস কি রমণীয়তা ধারণ করিয়াছে! দেখিলে বিশ্বনিয়ন্তার বিশ্বকার্য্য সকল মনোমধ্যে কি অদ্ভুত প্রতীয়মান হয়! তাঁহারা এই রূপ কথা কহিতে অস্তাচলাবলম্বী হইলেন। পৃথ্বীরাজ বলিলেন, দেখ দেখ প্রিয়ে সন্ধ্যাদেবী কি মনোহর রূপই ধারণ করিয়াছেন! দেখিলে মনোমধ্যে কি আনন্দ রস উচ্ছলিত হয়। কুমুদিনী নায়ক স্বীয় প্রিয়তমাকে প্রস্ফুটিত হইতে দেখিয়া যেন হাসিতেছেন; নক্ষত্রমালা তাঁহার চতুর্দিকে কি মনোহর ভাবেই শোভা পাইতেছে; কুমুদিনী স্বীয় সপত্নীগণকে স্বামীর পাশ্ববর্ত্তিনী দেখিয়া ঈর্ষায় বদন উত্তোলন করিতেছেন না; প্রিয়ে প্রকৃতির ও কি সপত্নীভাব আছে! শুনিয়া তারা ঈষৎ হাস্য করিলেন। এইরূপ কথোপথন করিতে করতে তাঁহারা অনেক পথ অতিক্রম করিয়া গেলেন।
ক্রমে রাত্রি গভীর ভাব ধারণ করিল। দেখিয়া পৃথ্বীরাজ বলিলেন, প্রিয়ে এই গভীর রজনীতে কত স্থানে ব্যাঘ্রের নায় অর্থলোলুপ তস্করগণ অর্থতৃষ্ণায় ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে—কত স্থানে বা পরানুরাগী লম্পটগণ অতি চকিত ভাবে নিঃশব্দে পরকীয় দ্বারোদঘাটন করিতেছে -কোন গৃহে দীর্ঘ বিরহের পর অপূর্ব্ব মিলন, কোন গৃহে বা দীর্ঘ মিলনের পর ঘোরতর বিরহ ঘটনা হইতেছে—কোথাও বা মানিনী স্ফীতাধরে নায়কের প্রতি কটাক্ষপাত করিতেছে— কোন কুলমহিলা শিশু সান্ত্বনায় ব্যস্ত হইয়া প্রিয়তমের শুশ্রুষায় পরাঙমুখ হইতেছে—কোথাও বা কোন উদ্ধত নবীন যুবা মোহান্ধ হইয়া নব পরিণীতা কামিনীকে পদাঘাত করিতেছে-কাহারাও বা নীরস গৃহ আলাপে মনকে চরিতার্থ করতেছে—কোথাও সপত্নীতে সপত্নীতে কোন্দল করিতেছে—কোথাও বা বিশুদ্ধ বিমল বিদ্যাচর্চ্চা হইতেছে-আহা কেমন সুস্নিগ্ধ মধুময় মন্দ মন্দ নিদাঘানিল বহিতেছে— বৃক্ষপত্রের মর মর শব্দে কর্ণ জুড়াইতেছে-মধ্যে মধ্যে বন্য কপোত সকল গম্ভীর রবে প্রহরির কার্য্য করিতেছে— কুসুমসকল কেমন বিকাশচ্ছলে হাসিতেছে—পবন তালে তালে গান করিয়া কর্ণে সুধা বর্ষণ করিতেছে। পৃথ্বীরাজের এইরূপ কথা সকল শুনিয়া তারার বিমর্ষ মনও কিঞ্চিং সুস্থ হইল। এদিকে রাত্রিও শেষ হইয়া আসিল। কুমুদিনী নায়ক অস্তাচলাভিমুখী হইলেন। রাজবাটী ক্রমশঃ অতি নিকট হইতেছে শুনিয়া তারা সম্পূর্ণরূপে নিস্তব্ধ হইলেন এবং পৃথ্বীরাজও চুপ করিয়া রহিলেন।
সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে তাঁহারা মিওয়ারের রাজ ভবনে আসিয়া পৌঁছিলেন। মহারাজ রায়মল আহ্লাদ সাগরে ভাসিতে লাগিলেন। পুত্র ও পুত্রবধূর মুখ নিরীক্ষণ করিয়া অপার স্বৰ্গসুখ অনুভব করিলেন। মাঙ্গল্য ক্রিয়া সমাপন হইলে পর মহারাজ কুম্ভমেরু নামক অপূর্ব্ব বাসস্থান নবদম্পতীর বাসের নিমিত্ত নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিলেন।