তারাচরিত/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শুভক্ষণ দেখিয়া রাজকুমার ও নববধূ কুম্ভমেরুতে প্রবেশ করিলেন। ঐ কুম্ভমেরুর সৌন্দর্য্যের কথা কি বলিব। উহার অনুপম শোভা নিবন্ধন প্রায় সকল লোকেই উহাকে কমল মেরু বলিত। আহা তাঁহাদের আবাস অট্টালিকা কতই সুন্দর। যদি বিধাতা সহস্ৰ লোচন দিতেন তাহা হইলে ও দেখিয়া সাধ মিটিত না! সেখানে বসন্ত সর্ব্বদাই বিরাজ করিতেছেন। কুসুম সকল প্রস্ফুটিত হইয়া বিশ্বরাজ্যের শোভা সম্পাদন করিতেছে। বৃক্ষ লতা সকল ফল ভরে অবনত হইয়া যেন বিশ্বস্রষ্টাকে শত শত ধন্যবাদ দিতেছে। কোমল কমল সকল পূর্ণ সরোবরে বায়ু ভরে দুলিতেছে। ভ্রমরগণ গুণ গুণ ধ্বনি করিয়া তাহাতে একবার বসিতেছে একবার উড়িতেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃক্ষ সকল আলবালে কি শোভাই পাইতেছে। কোকিল সকল স্থানে স্থানে বসিয়া কুহু কুহু করিয়া কমলমেরুর অধিকতর শোভা সম্পাদন করিতেছে। ময়ুর ময়ূরী সকল কেকা রব করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। শুক সারি সুখেতে বসিয়া প্রেমালাপ করিতেছে। থাকিয়া থাকিয়া পাপিয়া সকল যেন বসন্তের যশ ঘোষণা করিতেছে। মারুত হিল্লোলে পাদপ শাখা সকলকে দুলাইতেছে। পৃথ্বীরাজ ও তারা সেই কমলমেরুতে অবস্থান করিয়া দাম্পত্যের অপূর্ব্ব অনির্ব্বচনীয় সুখ অনুভব করিতে লাগিলেন।
একদা, পৃথ্বীরাজ জয়লাভান্তে, কোন যুদ্ধস্থল হইতে প্রত্যাগত হইয়া তারাকে যুদ্ধের সমুদয় বৃত্তান্ত বলিতে বলিতে কমলমেরুর নৈসৰ্গিক শোভা সন্দর্শন করিতেছেন। তাহাতে তারা যার পর নাই হর্ষান্বিত হইয়া অঙ্গুলি নির্দেশ দ্বারা বলিলেন নাথ দেখ দেখ ঐ অশোক তরুটীর সঙ্গে মাধবী লতার কি অপূর্ব্ব সংযোগ হইয়াছে! আহা ইহাদের উভয়ের মিলন কি নয়ন প্রীতিকর। পৃথ্বীরাজ শুনিয়া বলিলেন প্রিয়তমে মাধবী আপনিই অশোককে প্রণয় গুণে আবদ্ধ করিয়াছে। আরও দেখ প্রিয়ে তার নিকটে উচ্চ শাল্মলী বৃক্ষ রহিয়াছে কিন্তু মাধবীর একটী শাখাও সে দিকে যায় নাই। পৃথ্বীরাজ অপর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন প্রিয়ে দেখ দেখ অপরাজিতা করবীর আশ্রয় করিয়া কি অনির্ব্বচনীয় শোভা সম্পাদন করিতেছে। করবীর কোলে অপরাজিতার অপূর্ব্ব মধুর নিলীমা কি আশ্চর্য্য মানাইতেছে। আবার করবীর কোলে অপরাজিতাকে দেখিয়া চপলার যেন আর হাসি ধরিতেছে না বোধ হইতেছে। এই বলিয়া পৃথ্বীরাজ তারার চিবুক ধরিয়া কহিলেন অয়ি মুগ্ধে তুমি কি জাননা যে যেমন পাত্র তার উপযুক্ত পাত্রী হইলে কি উত্তমই হয়। তারা ভাবে গদগদ হইয়া বলিলেন, দেখ দেখ নরেশ্বর ঐ চম্পকের আর ঝুনুকালতার কি অনির্ব্বচনীয় শোভাই হইয়াছে। আবার দেখ তরুলতা কেমন নিজ ভুজযুগ দ্বারা সহকারকে বেষ্টন করিয়া বহিয়াছে। দেখিলে বোধ হয় যেন, তরুলতা বিচ্ছেদের আশঙ্কায় শত বাহু বেষ্টনে পতির সর্ব্বাঙ্গ আবদ্ধ করিয়া রহিয়াছে। তরুর পতিনিষ্ঠা দেখিয়া আমার মনে হইতেছে যে আমি তোমাকে চিরকাল বক্ষস্থলে বাঁধিয়া রাখি, আর যেন আমাদিগের বিচ্ছেদ না হয়। এই কথা শুনিয়া পৃথ্বীরাজ তারার কোমল করতল আপনার বক্ষস্থলে স্থাপিত করিয়া বলিলেন প্রণয়িনি যেমন দেবাদিদেব মহাদেব বিশ্ব জননীর পাদপদ্ম বক্ষস্থলে স্থাপন করিয়াছিলেন আমিও তেমনি অদ্যাবধি তোমাকে আমার হৃদয় দান করিলাম। এই বলিতে বলিতে পৃথ্বীরাজ তারাকে বক্ষস্থলে ধারণ করিলেন।
এইরূপে তাঁহারা কথোপকথন করিয়া চিরদিনের পিপাসিত মন চরিতার্থ করিতেছেন; উভয়ে উভয়ের মুখচন্দ্রিমা নিরীক্ষণে অপার আনন্দে সন্তরণ করিতেছেন, এবং, কমলমেরুর শোভা দেখিতেছেন। এবং কতই কি ভাবিতে ছেন। হায় যে দিনে অকস্মাৎ এই সুখের সাগর একবারে শুষ্ক হইবে, যে দিনে বিধাতার লিখনানুসারে এক অশনিপাতে দুই জনের প্রাণ যাইবে, সেই দুর্দিন প্রভাত হইতে চলিল। সেই উপস্থিত ভয়ঙ্কর ঘটনা আমি কেমন করিয়া বলিব। রে বিধাতঃ! তোমার মনে কি এতই ছিল! হায় কেমন করিয়া এই নবীন দম্পতী কুসুমকে অকালে হরণ করিবি! হায়, তোমার নিকট, কি ধনবান কি নির্ধন, কি শৌর্য্যবীর্য্যশালী পুরুষ কি নির্ব্বল কিছুরই বিচার নাই। রে কাল! তোমার কঠিন দন্তে সকলই চূর্ণ হইতেছে। তোমার মায়া নাই, দয়া নাই। তোমার হৃদয় কি পাষাণে নির্ম্মিত যে কাহার উপর দৃষ্টিপাত কর না? তুমি রাজা দেখিয়াও ভয় পাও না, তুমি গরিব দেখিয়াও দয়া কর না। তোমার কি একই গতি। তোমার কি কিছুই বিবেচনা নাই! তোমাকে বিনয় করি আর কাহাকেও এই রূপ করিও না। মনুয্যের সাধ্য কি যে তোমার গতি নিরোধ করে। তোমার সাহায্যেই সকল হইতেছে, অথবা, তুমিই সকল করিতেছ, কেবল মনুষ্য নিয়তির ভাগী হইয়া দুর্নামগ্রস্ত হইতেছে। যাহা হউক তোমাকে ধন্য! যে তোমার করাল কবলে একবার পড়িয়াছে তাহার আর নিস্তার নাই। উঃ তুমি কি কঠিন হৃদয়! এই অপরিসীম রূপ রাসি দেখিয়া কি তোমার হৃদয়ে দয়া হইতেছে না!