দুর্নীতির পথে/বিবাহ-সংস্কার

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম অধ্যায়

বিবাহ সংস্কার

 যে অধ্যায়ে যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য পালনের বিষয় লিখিত হইয়াছে, তার পরের অধ্যায়গুলিতে বুয়ো বিবাহের কর্তব্য এবং বিবাহবন্ধনের অচ্ছেদ্যতা বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন। যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য পালনকেই সর্বোচ্চ আসন দেওয়া সত্ত্বে তিনি বলিয়াছেন অধিকাংশ লোকের পক্ষে ইহা সম্ভবপর নহে বলিয়া, তাহাদের বিবাহ করা কর্তব্য। তিনি দেখাইয়াছেন যে, বিবাহের উদ্দেশ্য এবং বিবাহিত জীবনের নিয়মগুলি ঠিকরূপে বুঝিতে পারিলে জন্ম-নিয়োধের জন্য কৃত্রিম উপায় অবলম্বনের পক্ষে বলার কিছুই থাকে না। কুশিক্ষার ফলেই বর্তমান সময়ে দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। তথাকথিত অগ্রগামী লেখকগণ বিবাহপ্রথাকে উপহাস করিয়াছেন। বুরো ইহাদের মত আলোচনা করিয়া লিখিতেছেনঃ-

 “এই সকল ভুয়া নীতিবিদগণের মধ্যে প্রায় সর্বত্রই প্রকৃত নীতিজ্ঞানের অভাব দেখা যায়। এমন কি অনেক স্থলে ইহাদের মধ্যে খাঁটি সাহিত্যিকতারও অভাব লক্ষিত হয়। তবে ভবিষ্যৎ বংশীয়দের পক্ষে মঙ্গলের কথা এই যে, ইহাদের মত বর্তমান কালের প্রকৃত মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিদগণের মতের সম্পূর্ণ বিরোধী। চিন্তাশীল লোকে মনোরা এবং জীবনের গভীর তত্বগুলি যে ভাবে আলোচনা করেন, তার সহিত বর্ত্তমান কালের হৈ চৈ পূর্ণ সংবাদপত্র, উপন্যাস এবং থিয়েটারের বিরোধ এই যৌনসম্বন্ধের আদর্শ বিষয়ে যত অধিক, এমন আর কিছুতে নয়।”

 শ্রীযুক্ত বুরো সাহেব বিবাহ-নিরপেক্ষ অবাধ মিলনের পক্ষপাতী নহেন। তিনি মডেষ্টিনের সহিত একমত এবং ইঁহাদের মতে, ‘বিবাহ নরনারীর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য যোগ স্থাপন করে, এই মিলন চিরজীবনের জন্য এবং ইহা দ্বারা মানবজীবনের শ্রেয় ও প্রেয় একীভূত হয়। বিবাহ কেবলমাত্র একটি আইনের চুক্তি নয়, ইহা একটি ধর্ম্মানুষ্ঠান এবং ইহার গুরুতর নৈতিক দায়িত্ব আছে। ইহার কল্যাণে বনের মানুষ সভ্য হইয়াছে। বিবাহ হইলেই নরনারী যাহা খুসি করিতে পারে এরূপ ভাবিলে অত্যন্ত ভুল করা হইবে; এমন কি স্বামী স্ত্রী যখন সন্তানোৎপাদনের নীতি লঙ্ঘন করেন না, তখনও কেবলমাত্র বিলাস বাসনা চরিতার্থ করার জন্য নানাপ্রকার মৈথুনভঙ্গীর আশ্রয় লওয়া অনুচিত। এই নিষেধ ব্যক্তিগতভাবে তাহাদের যতখানি উপকার করিবে, সমাজেরও ততখানি উপকার করিবে। দেখিতে হইবে বিবাহ যেন সমাজের মঙ্গল ও পরিপুষ্টির কারণ হয়।’ লেখক বলিতেছেন, ‘পূর্ণ সংযমের পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া যৌনপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার সুযোগ বিবাহিত জীবনে সর্ব্বদাই উপস্থিত হয়, এবং এগুলি প্রকৃত প্রেমের বাধাস্বরূপ। এই বিপদ হইতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় সর্ব্বদা সতর্ক থাকা যেন ইন্দ্রিয়ভোগের পরিমাণ বিবাহের উদ্দেশ্যানুমোদিত গণ্ডী অতিক্রম না করে। স্যালেসের সাধু ফ্রান্সিস বলেন, “তীব্র ঔষধ সেবন করা সব সময় বিপজ্জনক। কারণ যদি মাত্রা বেশী হইয়া পড়ে, অথবা ঔষধ প্রস্তুত করায় কোনো দোষ থাকে, তবে গুরুতর ক্ষতি হয়। বিবাহ ধর্ম্মানুমোদিত এবং লাম্পট্য নিবারণ ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য। ইহা লাম্পট্যের ঔষধ বটে, কিন্তু এ বড় জোরালো ঔষধ; সুতরাং সাবধানে ব্যবহার না করিলে ইহাতে বিপদও ঘটে।”

 কেহ কেহ বলেন, ‘সকলেই স্বেচ্ছামত বিবাহ করিতে বা বিবাহ ভঙ্গ করিতে পারে কিংবা কোনো প্রকার দায়িত্ব গ্রহণ না করিয়া অবাধে ইন্দ্রিয়সেবা করিতে পারে।’ শ্রীযুক্ত বুরো এই মত খণ্ডন করিয়াছেন। তিনি বলেন, ‘নিজের ইচ্ছামত বিবাহ করার অথবা নিজের সুবিধার জন্য অবিবাহিত থাকার অধিকার সকলেরই আছে এরূপ মনে করা ভুল। আরও ভুল হইবে যদি আমরা মনে করি যে, খুসীমত বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন করার অধিকার স্বামী-স্ত্রীর আছে। পরস্পরকে মনোনীত করিয়া লইবার স্বাধীনতা সকলেরই আছে কিন্তু মনোনয়নের পূর্ব্বেই, নবজীবনের দায়িত্বভার যাহার সহিত একসঙ্গে বহন করিতে হইবে, তাহার সম্যক পরিচয় লওয়া এবং সে সম্বন্ধে বিশেষভাবে বিবেচনা করা আবশ্যক। কিন্তু বিবাহ হইয়া গেলে এবং একবার স্ত্রী পুরুষের দৈহিক মিলন সংঘটন হইলে তাহার বিপুল ফল কেবল দুটিমাত্র প্রাণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকিয়া নানাদিকে বহুদূর পর্য্যন্ত বিস্ত‌ৃত হইয়া পড়ে। বর্ত্তমান কালের উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের যুগে দম্পতির পক্ষে এই ফলের গুরুত্ব উপলব্ধি করা হয়ত সম্ভব নয়; কিন্তু যখনই গৃহের ভিত্তি নড়িয়া যায় এবং উচ্ছৃঙ্খল ইন্দ্রিয়লালসা একবিবাহের মঙ্গলকর সংযমের স্থান অধিকার করে তখনই সমাজদেহে নানাপ্রকার পীড়া উপস্থিত হইয়া ঐ গুরুত্ব উপলব্ধি করায়। এসব বহুদূর বিস্ত‌ৃ‌ত ফলাফল এবং সূক্ষ্ম কার্য্যকারণ সম্বন্ধগুলি যিনি উপলব্ধি করিতে সক্ষম তিনি, মানুষের অন্যান্য প্রথার মত বিবাহ প্রথাও যে বিবর্ত্তনশীল ইহা জানিয়া ভীত হইবেন না, কারণ এ কথা নিশ্চিত যে, বিবাহবন্ধন যত নিবিড় হইবে, বিবাহের আদর্শও তত উন্নত হইবে। পরস্পরের মধ্যে বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন করিবার অধিকার দাবী করিয়া আজকাল বিবাহবন্ধনের অচ্ছেদ্যতার বিরুদ্ধে যে আক্রমণ চলিতেছে, তাহাতে বিবাহবন্ধন যে অচ্ছেদ্য এই নীতির সামাজিক মূল্য আরও অধিক স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী যে নীতির সামাজিক মূল্য আমরা বুঝিতে পারি নাই পরন্তু যাহা আমাদের নিকট একটি ধর্ম্মের শাসন-মাত্র ছিল, তাহা যে ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের পক্ষেই একান্ত মঙ্গলকর—কালক্রমে ইহা আমাদের নিকট সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে।

 “বিবাহ-বন্ধন অচ্ছেদ্য এই নীতি একটি কথার কথা নহে, পরস্তু ইহার সহিত মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের নিগূঢ় যোগ আছে। যাঁহারা ক্রমোন্নতিবাদ প্রচার করেন, তাঁহাদের ভাবিয়া দেখা উচিত, কিসের দ্বারা মানবজাতির এই সর্ব্বজনবাঞ্ছিত অনন্ত উন্নতি সম্ভব হইতে পারে। ফোরষ্টার বলেন:—‘দায়িত্বজ্ঞান বৃদ্ধি, স্বেচ্ছায় শাসন মানিয়া লইবার শিক্ষা, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাগুণের উৎকর্য, স্বার্থপরতার দমন, ক্ষয়কর এবং উচ্ছৃঙ্খলতার পরিপোষক বৃত্তির আক্রমণ হইতে মনকে রক্ষা করা—মানুষের এই সকল গুণই অধিকতর উন্নত সামাজিক জীবনের পক্ষে সতত এবং একান্ত আবশ্যক। সহসা প্রবর্ত্তিত অর্থনৈতিক পরিবর্ত্তনের দরুণ মানব-সমাজে যে বিশৃঙ্খলা হওয়া সম্ভব, তাহা হইতে এই সকল গুণই আমাদিগকে রক্ষা করিবে। অর্থনীতিক্ষেত্রের নিশ্চলতা ও সাফল্যের সহিত অকৃত্রিম ও একনিষ্ঠ সামাজিক সহযোগিতার মিলন হইলেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির সামঞ্জস্য সাধিত হয়। এই সকল মূল কারণ উপেক্ষা করিয়া কোনো অর্থনৈতিক পরিবর্ত্তন আনিতে গেলে তাহা স্বতই কুফলদায়ী হইবে। অতএব যৌনসম্বন্ধের বিভিন্ন আদর্শগুলির প্রকৃত নৈতিক ও সামাজিক মূল্য নির্দ্ধারণ করিতে হইলে নিম্নলিখিত প্রশ্নটির উত্তর দিতে হইবে। কোন্ আদর্শে চলিলে আমাদের সমগ্র সামাজিক জীবনের গভীরতা ও শক্তি বৃদ্ধি হইবে? কিসে সর্ব্বদা আমাদের দায়িত্বজ্ঞান ও ত্যাগ প্রবৃত্তি বাড়িবে এবং লোভ, চঞ্চলতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা কমিবে? এই সব দিক হইতে বিষয়গুলি বিবেচনা করিলে সন্দেহ থাকে না যে, এক-বিবাহ প্রথাই সকল উন্নত সভ্যতার অংশ এবং প্রকৃত উন্নতি বিবাহবন্ধনকে শিথিল না করিয়া নিবিড় করে। দায়িত্বজ্ঞান, সহানুভূতি, আত্মসংযম, সহিষ্ণুতা এবং পরস্পরের নিকট শিক্ষালাভ করা—সামাজিক জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় এই সব গুণের শিক্ষাক্ষেত্র পরিবার। পরিবার শিক্ষার এই কেন্দ্রস্থানটি অধিকার করিয়া রহিয়াছে, কারণ পারিবারিক বন্ধন অচ্ছেদ্য ও চিরস্থায়ী এবং এই স্থায়িত্বের দরুণ পারিবারিক জীবন অন্য প্রকার জীবন অপেক্ষা গভীরতর, দৃঢ়তর এবং পরস্পর মিলনের পক্ষে অধিক উপযোগী। এক-বিবাহ প্রথাকে মানুষের যাবতীয় সমাজব্যবস্থার মর্ম্মস্থল বলা যাইতে পারে।”

 তারপর বুরো অগস্ত কোঁত্ এর লেখা উদ্ধৃত করিতেছেন, “আমাদের হৃদয় এত চঞ্চল যে, ইহার চঞ্চলতা ও খেয়ালসমূহ সংযত রাখার জন্য সমাজকে হস্তক্ষেপ করিতে হয়; নতুবা মানুষের জীবন কতকগুলি অকিঞ্চিৎকর ও অর্থহীন অভিজ্ঞতার সমষ্টি মাত্র হইয়া পড়ে।

 ডাক্তার টুলু বলেন, ‘প্রণয়প্রবৃত্তি অদম্য এবং ইহার দাবী যে-কোনো উপায়ে পূরণ করিতে হইবে এই ভ্রান্ত ধারণা বহু দম্পতির সুখের অন্তরায় হইয়া থাকে। প্রবৃত্তির কবল হইতে ক্রমশ মুক্ত হওয়াই কিন্তু মানুষের। মনুষ্যত্ব বৃদ্ধি ও তাহার ক্রমবিকাশের চিহ্ন স্বরূপ। বাল্যকালেই মানুষ তাহার স্থুল অভাবগুলি দমন করিতে চেষ্টা করিবে এবং বয়সের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে প্রবৃত্তি-সংযম শিখিতে হইবে। ইহা কল্পনামাত্র নহে এবং ইহাকে কাজে পরিণত করাও অসাধ্য নহে। কারণ যাহাকে আমরা ইচ্ছাশক্তি বলি সেই শক্তির দ্বারা আমাদের স্বভাব গঠিত হয়। ধাতে সয় না বলিয়া যখন লোকে দায়িত্ব এড়াইতে চায়, তখন বুঝিতে হইবে ইহা দুর্ব্বলতা ভিন্ন আর কিছুই নহে। যে ব্যক্তি বাস্তবিক বলবান, উপযুক্ত সময়ে সে তাহার শক্তি প্রয়োগ করিতে জানে।